‘দৃষ্টিনন্দন পৌরসভা গড়ে তোলা হবে।’ এটি একটি পুরনো স্লোগান। সময়ে সময়ে এই স্লোগানটা ব্যবহার করা হয়। যাঁরা শহরকে ভালোবাসেন, শহরকে অন্তর থেকে সুন্দর দেখতে চান, এই স্লোগানটি তাঁদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্লোগানের একটি। গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় এই স্লোগানটি আমাদের প্রিয় পুরপতি নাদের বখতের উক্তিমূলক শিরোনাম হয়ে প্রকাশ্যে এসেছে এবং একজন পুরপতি যখন এমন স্লোগানকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন তখন অবশ্যই তার একটা পৃথক তাৎপর্য থাকে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
মনে রাখতে হবে শহরকে দৃষ্টিনন্দন অর্থাৎ দেখতে সুন্দর হলেই চলে না, শহরকে মনের দিক থেকেও সুন্দর হতে হয়। শহরে মানুষ থাকে এবং মানুষের মন আছে, তাই শহরেরও মন থাকা স্বাভাবিক। মনকে বদলানো যেতেই পারে। মানুষ চেষ্টা করলে মনকে বদলে দিতে পারে। রতœাকর দস্যু কবি বাল্মীকিতে বদলে গিয়েছিলেন। একা একজন ঐকান্তিক চেষ্টায় নিজের মন বদলে দিতেই পারেন। কিন্তু সমাজমানসতা কিংবা একটি পুরো শহরের মানুষের মন বদলে দেওয়া সে-এক কঠিন সাধনা। তার জন্য চাই পুনর্জাগরণ, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, ইংরেজিতে যাকে বলে রেনেসাঁ।
পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষের জন্ম হয়েছে যারা দেখতে সুন্দর ছিলেন না কিন্তু মনের ঐশ্বর্যে তাঁরা ছিলেন সর্বোত্তম ও সুন্দর। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে একটি চেহারা নিয়ে জন্ম নেয়। প্লাস্টিক সার্জারির ব্যতিক্রম বাদে, সেটা বদলানো যায় না। শহরের মুখ কিংবা চেহারাকে যথাসাধ্য বদলানো যায়। প্রতিদিন আমাদের শহরের চেহারা পাল্টে যায়। বিভিন্ন প্রচারপত্র, বিজ্ঞাপনপাটা (বিলবোর্ড), নতুন নতুন দালান, রঙিন নামপাটা (সাইনবোর্ড) শহরের চেহারাকে বদলে দেয়। কিন্তু শহরের মন কখন কতোটা বদলায় তার হিসেব সহজে মিলে না। গ্রাম থেকে এখানে এসে যখন লোকেরা রাজনীতিক দলের ভিড় বাড়ায়, দেহমনে ভাড়া খাটে, ভাড়াটে সন্ত্রাসী হয় কিংবা সুপারি নেয়, যে-বস্তিতে থাকে সেই বস্তিতে আগুন দেয়, তখনও শহরের মনে এক ধরনের বদল ঘটে। শহর মানুষকে বদলে দিয়ে গোটা মানুষটাকেই পণ্য করে তোলে। মানুষকে বদলে দিয়ে অমানবিক করে তোলতে শহরের জুড়ি নেই। কেউ কেউ বলেন, এই শহরের মন ইট-ক্রংক্রিটের মন। বড় বেশি হিসেবি, বড় বেশি নিষ্ঠুর। এই জন্য বলি, শহরের মনকে বদলানো চাট্টিখানি কথা নয়। প্রায় অসম্ভব কিন্তু একেবারে অসম্ভব কখনওই নয়।
দৃষ্টিনন্দন পৌরসভা কে না চায়। আমি যে শহরটিতে থাকি তার আবাসিক পরিবেশ সুন্দর হোক এটাই আমার কাম্য। শহরের রাস্তা ঘাট নোঙরা দেখতে চাই না, ফুটপাত কেউ দখল করে রাখুক চাই না, রাস্তাগুলো খোয়া উঠে গাতাগর্তে ভরা থাকুক চাই না। এইগুলো সকল শহুরেরই মনের কথা। কিন্তু শহুরেদের এই মনকে সুন্দর করার কোনও উপায় কোথাও অবশিষ্ট নেই। পুঁজিবাদ তার কোনও অবশেষ রাখেনি (সে অন্য কথা)। একটি সুন্দর শহর যদি বদ লোকে ভরা থাকে তবে সে-সুন্দর শহরের কোনও মূল্যই থাকে না। সে-জন্য চাই শহরের বাইরেটাকে সুন্দর করার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটাকেও সুন্দর করে তোলার প্রচেষ্টা চালানো, সাংস্কৃতিক কর্ম পরিচালনা করা। অর্থাৎ দৃষ্টিনন্দন পৌরসভা গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে সুসংস্কৃত পৌরসভা গড়ে তোলার প্রকল্পও হাতে নিতে হবে।