মোঃ শাহাদত হোসেন ::
জনাব রফিকুল ইসলাম সরকারি চাকরি করেন। তার দু’সন্তান স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করে। তিনি সর্বসাকুল্যে মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা বেতন-ভাতা পান। তা থেকে ১০ হাজার টাকা দেন ঘরভাড়া। ১০ হাজার টাকা খরচ করেন সন্তানদের লেখাপড়া অর্থাৎ স্কুল-কলেজের বেতন, তাদের যাতায়াত, বইপত্র ও খাতা-কলম কেনা, শিক্ষকের কাছে পড়ানো ইত্যাদি খাতে। আর ১৭/১৮ হাজার টাকা খরচ করেন সংসারের কাজে, বাকি ২/৩ হাজার টাকা সঞ্চয় করেন।
জনাব ফজলু মিয়া একজন কৃষক। চাষাবাদ করে তিনি বছরে প্রায় ১ লক্ষ টাকা আয় করেন। তারও দু’সন্তান স্কুলে পড়ে। আয়ের ৫০ হাজার টাকা চলে যায় তার ভরণ-পোষণ বাবদ, ২০ হাজার টাকা চলে যায় সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ হিসেবে আর অবশিষ্ট ৩০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি আবার নতুন বছরের চাষাবাদ করেন।
জনাব সাজিদুর রহমান একজন ব্যবসায়ী। তিনি মাসে প্রায় ১ লক্ষ টাকা আয় করেন। তার বড় সন্তান তার সাথে ব্যবসার কাজে সহায়তা করে। ছোট সন্তান একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, থাকে হোস্টেলে। তিনি তার আয় থেকে ১৫ হাজার টাকা বাড়িভাড়া দেন, সন্তানের পড়াশোনার জন্যে তাকে পাঠান ২০ হাজার টাকা, সংসারে খরচ করেন ৩৫ হাজার টাকা আর ৩০ হাজার টাকা ব্যবসায় মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করেন।
অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিই সংসারের অন্যান্য খরচের সাথে সাথে তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্যে আয়ের একটা বড় অংশ খরচ করে থাকেন। বর্তমানে ভোগ না করে কেন তারা এতটাকা সন্তানের পিছনে খরচ করছেন? কারণ, তারা চান তাদের সন্তান মানুষের মত মানুষ হোক, ভবিষ্যতে সুখে শান্তিতে থাকুক।
এরকম প্রত্যাশা কি শুধু বাংলাদেশের মানুষের? না, তা নয়। পৃথিবীর সকল দেশের বাবা-মা’রাই চান তাদের সন্তান সত্যিকারের মানুষ হোক, দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে উঠুক, সারা জীবন সুখে ও নিরাপদে কাটাক। আর সে জন্যে তারা সবাই সন্তানের পিছনে অকাতরে ব্যয় করেন। তাই সন্তানের পিছনে ব্যয় করাটাকে তারা সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেন।
শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রও তার সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। আর সে কারণে তাদের পিছনে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে। কেননা, আজকের শিশুই যে আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই তাদেরকে যোগ্য, দক্ষ, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে। কেননা, ব্যক্তির মত করে রাষ্ট্রও তার সন্তানদের ভবিষ্যতের সুখ-সমৃদ্ধির কথা ভাবে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু নিজ সন্তানকে যোগ্য, দক্ষ, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে বাংলাদেশের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা উচিত, আমরা তা করতে পারছি না বা করছি না। সাধারণভাবে বলতে গেলে জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ২০% অথবা মোট জিডিপি’র ন্যূনতম ৬% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এ বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের কম-বেশি ১২% অথবা মোট জিডিপি’র প্রায় ২%-এর কাছাকাছি। অর্থাৎ যোগ্য, দক্ষ, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে যে পরিমাণ ব্যয় করা উচিত, আমরা করছি তার অর্ধেক মাত্র।
ব্যাপারটা হলো এরকম যে, বাদল সাহেব তার জমির উপর একটি ৫ তলা দালান তৈরির পরিকল্পনা করলেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হিসেব-নিকেষ করে জানালেন যে, এ দালান তৈরি করতে ১ কোটি টাকা লাগবে। কিন্তু বাদল সাহেব ঠিক করলেন, তিনি ৬০ লক্ষ টাকা দিয়েই এ দালান তৈরি করবেন। প্রয়োজনে ব্যবহার করবেন নি¤œমানের সামগ্রী। আর করলেনও তাই। এই দালান যে ভূমিকম্পে ভেঙে যাবে তা বোঝার জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদেরও হয়েছে এ অবস্থা।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণে ২০১০ সালে প্রণীত হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০। এ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্যেও বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো অত্যাবশ্যক। কিন্তু আমরা তা করতে পারছি না। পারছিনা দারিদ্রপীড়িত সংসারের মত দেশের বাজেটেও টানাপোড়েন থাকে বলে। চিকিৎসা, রাস্তাঘাট, শিল্প, নিরাপত্তা ইত্যাদি খাতেও বরাদ্দ বাড়িয়ে দিতে হয় বলে। কিন্তু একটু ভালোভাবে চিন্তা করলে এবং অগ্রাধিকার খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দিলে এ সমস্যা থাকে না।
বিগত কয়েক বছরের বাজেট লক্ষ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে প্রত্যাশিত বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না। অধিকন্তু প্রতি বছর এ খাতে বরাদ্দ বাড়ার প্রত্যাশা থাকলেও আনুপাতিক হারে তাতো বাড়ছেই না বরং অনেক সময় তা কমেছে। যেমন ২০১৪-১৫ সালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৩.১% আর ২০১৭-১৮ সালে ১১.৪%।
আমরা মনে করি, বাজেট বরাদ্দে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষাকে। এরপর ক্রমান্বয়ে কৃষি, শিল্প, চিকিৎসা, যোগাযোগ ও সামাজিক উন্নয়ন খাত গুরুত্বের দাবি রাখে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে? তার কারণ হল, শিক্ষাক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য লাভ করতে পারলে অন্যান্য সেক্টরেও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। কেননা অন্যান্য সকল সেক্টরের উন্নয়ন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। দেশে কাক্সিক্ষত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠলে দুর্নীতি কমবে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পাবে, প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটবে, বৈদেশিক আয় বাড়বে, রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, অন্যান্য সেক্টরে আরো কম ব্যয়ে আরো বেশি সুফল পাওয়া যাবে।
একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ কোনটি? কৃষি, খনিজ সম্পদ, শিল্প কারখানা নাকি রাস্তাঘাট? আমাদের মতে, একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানুষ, অবশ্যই মানুষ। আর তাই, মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষাখাতের বরাদ্দকে বিনিয়োগ হিসেবে ভাবতে হবে। আজ যা বিনিয়োগ হবে, তার সুফল পাওয়া যাবে ১০/১৫ বছর পর। তাই ভবিষ্যতের সুখের কথা ভেবে, সমৃদ্ধির কথা ভেবে শিক্ষাখাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ করতে হবে।
[লেখক মো. শাহাদত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, সুনামগঞ্জ।]