এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “কিন্তু প্রশিক্ষিত ট্যুরিস্ট গাইডের অভাব, নিরাপদ যানবাহনের অপ্রতুলতা, থাকা-খাওয়ার উন্নত ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকরা ভোগান্তিতে পড়েন।’ খুব ঠিক কথা। বাস্তবিক অবস্থা তাই। জানিয়ে রাখি, টাঙ্গুয়ার কথা বলা হচ্ছে। আসলে প্রতিবেদক টাঙ্গুয়ার বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করতে গিয়ে সেখানে ‘পর্যটক বান্ধব অবকাঠোমো’র অনুপস্থিতির কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁকে সাধুবাদ জানাই।
গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, “রূপ দেখাচ্ছে টাঙ্গুয়া”। প্রতিবেদনটিতে টাঙ্গুয়াকে কেন্দ্র করে পর্যটনবান্ধব কাঠামোর অনুপস্থিতির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বলা হয়নি প্রায় দেড় কোটি বছর আগের ‘টাঙ্গুয়ার প্রাকৃতিক কাঠামো’ পুনরুদ্ধারের কথা। কমবেশি একযুগ আগে টাঙ্গুয়ায় একটি জীবতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালিত হয়েছিল। সে-জীবতাত্ত্বিক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, টাঙ্গুয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রায় দেড় কোটি বছরের পুরনো। এই প্রাকৃতিক পরিবেশটা টাঙ্গুয়াতে দশক দুয়েক আগে পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল, সেটা এখন আর নেই। প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের একটি অপরূপা টাঙ্গুয়াকে বর্তমান প্রজন্মের মানুষ দেখতে পারবে না, যদি না টাঙ্গুয়াকে অতীতের রূপে আবার ফিরিয়ে আনা যায়। বর্তমানের টাঙ্গুয়া তার আসল রূপ হারিয়ে রূপসীদের কাতারে দাঁড়ানো একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এভাবে বললে বোধ করি প্রকৃত সত্য প্রকাশ থেকে একটুখানি হলেও সরে আসা হলো, আসলে বলা উচিত মৃত্যুপথযাত্রী টাঙ্গুয়ার রূপটাও পর্যটকদের মনোরঞ্জনে অদ্বিতীয়, যে-রূপটাকে শিরোনাম করে বলা হয়েছে ‘রূপ দেখাচ্ছে টঙ্গিুয়া’, সত্যি টাঙ্গুয়া এতোই রূপসী যে, তার মুমূর্ষুতার রূপটি দেখার মতো অপরূপ সুন্দর, যে-সুন্দর পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। আসলে টাঙ্গুয়া এখন পর্যটকদেরকে যে-রূপ দেখাচ্ছে তাতে হিজল, করচ, বরুণ, কদম, বট, জারুল, বল্লুয়া, নল, খাগড়া, ইকর, শিয়ালমৈত্রী ইত্যাদি হাজার রকমের বৃক্ষলতাগুল্ম নেই। নেই কুড়রুয়া, শকুন, কাইম, বনমোরগ ইত্যাদিসহ বিভন্ন প্রজাতির খেচর। নেই বেরকুল, পাঙ্গাস, বাঘাইর, এলং, মহাশোল, কচ্ছপ, গুইসাপ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজপ্রাণী। নেই বনবিড়াল, হরিণ, বাঘ, ফেউয়ালি, শূয়র, সজারু ইত্যাদি। জলজস্থলজ ও খেচরদের বিচিত্র সমাহারে জীববৈচিত্রে জীবন্ত অপরূপ টাঙ্গুয়ার মতো জলাশয় জগতে আর একটিও ছিল না। অতীতের টাঙ্গুয়ার অপরূপ সে-রূপ এখন আর নেই।
এখন টাঙ্গুয়া দেখতে পর্যটকরা আসছেন এবং পর্যটকদের ‘রূপ দেখাচ্ছে টাঙ্গুয়া’। এর অর্থ একটাই, বীতরূপা টাঙ্গুয়াকে রূপসী দেখিয়ে বর্তমানে পুঁজিবাদ বাণিজ্য করতে চায়, তার চাই মুনাফা। অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের চমক লাগিয়ে, প্রচারের যাদুবিস্তার করে পুঁজিবাদ টাঙ্গুয়ার বীতযৌবনকে বিক্রি করে কটি টাকা উপার্জন করতে চায়। এখন পুঁজির চাই টাঙ্গুয়ার পাড়ে পাড়ে সুদৃশ্য হোটেল-মোটেল, পর্যবেক্ষণাগার, চাই আধুনিক সব অবকাঠামোর উন্নয়ন। কিন্তু টাঙ্গুয়ার পূর্বরূপ অর্থাৎ আগের প্রাকৃতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কোনও আয়োজন করা হবে না। টাঙ্গুয়ার পাড়ে ও কান্দায় কান্দায় নলখাগড়ার বনসৃজনে অর্থাৎ টাঙ্গুয়ার জৈবপ্রকৃতি পুনরুদ্ধারের জন্য বাজেটের একটি টাকাও খরচ হবে না। যদি বাজেট থেকে কোনও বরাদ্দ দেওয়া হয়, তবে দুর্নীতিবাজরা সে-বারাদ্দ টাঙ্গুয়ার উন্নয়নের নামে লুটেপুটে খাবে, কিন্তু উন্নয়ন হতে দেবে না। টাঙ্গুয়া রক্ষণের নামে টাঙ্গুয়াকে ন্যাড়া বানিয়ে দেবে। টাঙ্গুয়ার জীববৈচিত্র্যের উন্নয়নের কোনও দরকার নেই। টাঙ্গুয়াক আরও অধিক মাত্রায় কীভাবে শোষণ করা যায়, টাঙ্গুয়াকে বিক্রি করে কীভাবে পুঁজির স্ফীতি ঘটানো যায় তার সকল ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হবে।
আর বলতে চাই না। অনেক বলে ফেলেছি। মনে হচ্ছে, অনধিকার চর্চা করে ফেললাম কি না। তারপরও বলতে চাই, মুমূর্ষু টাঙ্গুয়াকে রক্ষা করুন। এখনও সময় আছে।