1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৮ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

আমার ভাষা আমার দায়িত্ব

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৮

মুহম্মদ জাফর ইকবাল ::
মাসখানেক আগে আমি কলকাতায় ভাষা-সংক্রান্ত একটি কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। একটা সময় ছিল, যখন ভাষা নিয়ে গবেষণা করতেন ভাষাবিদেরা, প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতেন প্রযুক্তিবিদেরা। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে এখন অনেক প্রযুক্তিবিদ ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন। আমাকে ডাকা হয়েছে সে কারণে। ভারতবর্ষে অনেক ভাষা, বাংলাভাষা সেগুলোর মাঝে একটি। আমাদের একটিমাত্র ভাষা, কাজেই বাংলা ভাষার গুরুত্ব আমাদের কাছে অনেক।
অনুমান করা হয়, পৃথিবীতে এখন প্রায় সাত হাজার ভাষা রয়েছে। অনেকেই হয়তো চিন্তাও করতে পারবে না যে, এই সাত হাজার ভাষা থেকে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা ‘মৃত্যুবরণ’ করছে। ভাষা কোনও প্রাণী নয়, তাই তার জন্য মৃত্যুবরণ শব্দটা ব্যবহার করা যায় কিনা, সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু যখন একটি ভাষায় আর একজন মানুষও কথা বলে না, তখন ভাষাটির মৃত্যু হয়েছে বলা অযৌক্তিক কিছু নয়। অনুমান করা হয়, এই শতক শেষ হওয়ার আগেই পৃথিবীর অর্ধেক ভাষা মৃত্যুবরণ করবে। একটি ভাষা যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সঙ্গে বিশাল একটা ইতিহাসের মৃত্যু হয়, অনেক বড় একটা কালচারের মৃত্যু হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, একটি জাতি যখন আরেকটি জাতিকে পদানত করতে চায়, তখন প্রথমেই তারা তাদের ভাষাটির গলা টিপে ধরে।
একসময় পৃথিবীর ভয়ঙ্কর একটি দেশ ছিল সাউথ আফ্রিকা। সেই দেশের স্কুলের কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চাদের ওপর জোর করে আফ্রিকানা ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন প্রায় ২০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলের বাচ্চা প্রতিবাদ করে রাস্তায় নেমে এসেছিল। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সেদিন গুলি করে একজন নয়, দুই জন নয় প্রায় সাতশত স্কুলের বাচ্চাকে মেরে ফেলেছিল। ভাষার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে এর চাইতে বেশি প্রাণ দেওয়ার উদাহরণ আছে বলে আমার জানা নেই।
আমাদের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা এখন শুধু আমরা নই, সারা পৃথিবী জানে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শুধু তাই নয়, আমাদের এই দেশটির জন্মের ইতিহাসটি বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একইসঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু অনেকেই জানে না, বাংলা ভাষার জন্য আমাদের এই অঞ্চলে আরও একবার রক্ত ঝরেছিল। আসামের একটা বড় অংশ বাংলা ভাষায় কথা বলতো। তারপরও শুধু অহমিয়া ভাষাকে আসামের দাফতরিক ভাষা হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেখানকার বাঙালিরা তাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। সেই আন্দোলন থামানোর জন্য পুলিশ গুলি করে ১৯৬১ সালের ১৯ মে এগারোজনকে হত্যা করে। তার মধ্যে একজন ছিল ১৬ বছরের কিশোরী কমলা, মাত্র একদিন আগে সে তার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ করেছিল। আসামের বরাক উপত্যকার সেই রক্ত শেষ পর্যন্ত বৃথা যায়নি, সেখানকার তিনটি জেলায় বাংলাও এখন দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে, আমরা যত গৌরবের সঙ্গে আমাদের ভাষা শহীদদের স্মরণ করি, আসামের ভাষা শহীদের ততটুকু গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করা হয় বলে মনে হয়নি। আমরা একবার শিলচরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম, তখন সেখানকার বাঙালি শিক্ষকেরা দুঃখ করে বলেছিলেন, তাদের ভাষা আন্দোলনকারীদের স্মরণে তৈরি করা শহীদ মিনারটিও তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে করার অনুমতি পাননি। সেটি তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার বাইরে। আমি মনে করি, প্রতি বছর ১৯ মে দিনটিতে বরাক উপত্যকার সেই ভাষা শহীদদের বাংলাদেশে গভীর ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।
ভাষা মৃত্যুবরণ করতে পারে, জানার পর আমার এক ধরনের কৌতূহল হয়েছিল, তাহলে কি ভাষা অসুস্থ হতে পারে? ভাষাবিজ্ঞানীরা এখনও অসুস্থ ভাষা হিসেবে ভাষাগুলোকে চিহ্নিত করতে শুরু করেননি কিন্তু তার উল্টোটা আছে, ‘প্রভাবশালী’ ভাষা। কাউকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, কথা বলার সংখ্যায় তৃতীয় হয়েও পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। পৃথিবীতে যে ভাষায় যতবেশি মানুষ কথা বলে, তাদের প্রভাবও সে রকম। তবে দুটো চোখে পড়ার মতো ব্যতিক্রম রয়েছে, একটি হচ্ছে ফরাসি ভাষা। কথা বলার সংখ্যায় তারা অনেক পেছনে, প্রায় আঠারো নম্বর কিন্তু প্রভাবের দিক দিয়ে তারা একেবারে দুই নম্বর। আবার বাংলাভাষা কথা বলার সংখ্যায় পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ হয়েও প্রভাবের দিকে অনেক পেছনে, একেবারে আঠারো নম্বর। বলাই বাহুল্য, তথ্যটি দেখে আমি যথেষ্ট বিচলিত হয়েছি। আমাদের বাংলা ভাষা এত পিছিয়ে আছে কেন? যত দিন যাবে, সারা পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের ভাষাটি আরও পিছিয়ে যাবে? ভাষাটি কি আরও দুর্বল হয়ে যাবে?
এই মুহূর্তে বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষে বিশ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। এটি বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা, ভারতবর্ষ ও সিওরালিওনের দাফতরিক ভাষা। বাংলাদেশ ও ভারত এই দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাংলাভাষায়। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষায় কথা বলে এমন প্রায় এককোটি মানুষ পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তারপরও বাংলাদেশ প্রতাপের দিক দিয়ে এত পিছিয়ে কেন?
তার কারণ বাঙালিরা কখনও অন্য দেশকে কলোনি করে জোর করে নিজ ভাষাকে অন্য ভাষার ওপর চাপিয়ে দেয়নি, কখনও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ ছিল না যে, অন্য ভাষার মানুষ আগ্রহ নিয়ে এই ভাষা শিখবে। শুধু তাই নয় তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে যখন ভাষাকে ক¤িপউটারে ব্যবহার করার সময় এসেছে, তখন আমরা দেখছি বাংলা ভাষাকে তথ্য-প্রযুক্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে আছি! আমরা নিজেরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি, বাংলা ভাষাকে তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে স¤পৃক্ত করার ব্যাপারে আমাদের সেরকম আগ্রহ নেই, অপেক্ষা করে আছি পৃথিবীর বড় বড় প্রতিষ্ঠান কোনও একসময়ে আমাদের সমাধান করে দেবে এবং তখন সেই সমাধান ব্যবহার করে আমরা কৃতার্থ হয়ে যাবো। কাজেই আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম, যখন বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষার উন্নয়ন সংক্রান্ত গবেষণার জন্য প্রায় একশত ষাট কোটি টাকার বরাদ্দ করেছে। যখন এই প্রজেক্টটি শেষ হবে, তখন একধাক্কায় আমাদের হাতে বাংলা ভাষায় গবেষণা করার জন্য অনেক মাল-মশলা চলে আসার কথা।
কলকাতার কনফারেন্সে গিয়ে সেখানকার অনেক গবেষক অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে আমি একটি বিস্ময়কর বিষয় জানতে পেরেছি। আমাদের দেশে প্রাইমারি-সেকান্ডারিতে যারা পড়াশোনা করে, তাদের মাত্র পাঁচ শতাংশ ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। (৩০ শতাংশ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে, সেখানে আলিয়া মাদ্রাসার অংশটুকু বাংলা মাধ্যম)। অর্থাৎ বাংলাদেশের লেখাপড়ার মূল ধারাটি হচ্ছে মাতৃভাষায়, যেরকমটি হওয়া উচিত। কলকাতার ছবিটি একেবারে ভিন্ন। যেহেতু তাদের প্রতিযোগিতাটি করতে হয় পুরো ভারতবর্ষের সঙ্গে। তাই তারা আর নিজের মাতৃভাষায় পড়তে আগ্রহী নয়। সেখানে সবাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। শুধু যাদের কোনও গতি নেই, কোনও উপায় নেই, তারা বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করে। যার অর্থ, এভাবে চলতে থাকলে মূলধারার বাঙালি বাংলাভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং বাংলা ভাষার পুরো দায়িত্বটি এসে পড়বে আমাদের হাতে।
যেহেতু ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসছে, আমাদের বাংলাদেশের মানুষকেও এখন আগে থেকে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক হতে হয়। আমাদের লেখাপড়ার মাঝে তার ব্যবস্থা করে রাখা আছে, ছাত্রছাত্রীরা বাংলার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় বারো বছর ইংরেজি পড়ে। এই বারো বছর ইংরেজি পড়া হলে খুবই স্বাভাবিকভাবে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর ইংরেজিতে যথেষ্ট দক্ষ হওয়ার কথা। কিন্তু যে কারণেই হোক আমাদের সব ছাত্রছাত্রী ইংরেজিতে যথেষ্ট দক্ষ হচ্ছে না। বাবা-মায়েরা দুর্ভাবনায় পড়ছেন এবং অনেকেই মনে করছেন ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করানোই হয়তো তার সমাধান! কিন্তু আমরা সবাই জানি মাতৃভাষায় লেখাপড়া করার কোনও বিকল্প নেই। তাই আমরা যদি মাতৃভাষার দায়িত্বটি নিতে চাই, স্কুল কলেজে ঠিক করে ইংরেজি পড়াতে হবে। যদি স্কুল কলেজে লেখাপড়া করে ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট ইংরেজি শিখে যায়, তাহলে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করার জন্য ছুটে যাবে না।
কলকাতার ভাষা সংক্রান্ত কনফারেন্সে উড়িষ্যার একজন ভাষাবিদের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তার কাছে আমি জানতে পারলাম, ভারতবর্ষে প্রত্যেকটি শিশুর তিনটি ভাষা শেখার কথা, একটি হিন্দি, একটি ইংরেজি, অন্যটি নিজেদের মাতৃভাষা। আমাকে তথ্যটি দিয়েই ভদ্রলোক হতাশভাবে মাথা নেড়ে জানালেন, তাদের দেশে পদ্ধতিটি মোটেও ঠিকভাবে কাজ করছে না। কেন কাজ করছে না, আমরা মোটামুটিভাবে তার কারণটি অনুমান করতে পারি – প্রবল প্রতাপশালী ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার চাপে নিশ্চয়ই তাদের নিজেদের মাতৃভাষাটি কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। একজন শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে তিনটি ভাষা শিখে বড় হওয়া নিশ্চয়ই খুব সহজ নয়। ভারতের তুলনায় আমরা অনেক সুবিধাজনক জায়গায় আছি। মাতৃভাষার পাশাপাশি আমাদের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদের মাত্র একটি ভাষা শিখতে হয়। সেটি হচ্ছে ইংরেজি। সেই ইংরেজিটুকু যদি ভালো করে শেখানো হয়, আমার ধারণা আমাদের মাতৃভাষা অনেক বেশি নিরাপদ থাকবে!
এখানে আরও একটি বিষয় বলা যায়। আমরা এখন সবাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কিংবা নিউরাল নেটওয়ার্ক – এই ধরনের কথাগুলো শুনেছি। পৃথিবীতে গবেষণার জগতে এই বিষয়গুলো একেবারে নতুন একটি মাত্রা যোগ করেছে। এই বিষয়গুলো এখন যে কাজগুলো করতে পারে, সোজা ভাষায় সেটি শুধু যে অবিশ্বাস্য, তা নয় এটি রহস্যময়ও। গবেষণার এই নতুন মাত্রায় অবশ্যই আমাদের এখনও আনন্দ পাওয়ার বেশি কিছু নেই। কারণ এর জন্য প্রয়োজন উপাত্ত, লক্ষ লক্ষ উপাত্ত, কোটি কোটি উপাত্ত! কার আছে সেই উপাত্ত? আমাদের নেই। সেই উপাত্ত আছে ফেসবুকের হাতে, গুগলের হাতে, আমাজনের হাতে। এই উপাত্ত এখন সোনার থেকেও দামি। সেই উপাত্ত ব্যবহার করে তথ্য-প্রযুক্তির এই মহাশক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এখন শুধু আমাদের জীবন নয়, সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমাদের বলার কিছু নেই, কারণ তাদের সেবা গ্রহণ করে কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে আমরা তাদের হাতে আমাদের সব তথ্য, সব উপাত্ত উজার করে তুলে দিয়েছি!
কাজেই আগে হোক পরে হোক, আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সেই নড়বড়ে পা নিয়ে আমাদের লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, দেখতে দেখতে সেই পা শক্তিশালী হবে। অন্যের ঘাড়ে চড়ে বহুদূর দেখা যায়, কিন্তু তখন প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কায় থাকতে হয়, কখন তারা ঘাড় থেকে ছুড়ে কাদা মাটিতে ফেলে দেবে! জেনেশুনে কেন আমরা সেই ঝুঁকি নেবো?
[লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com