1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

মো. সাবিরুল ইসলাম : একজন স্বপ্নবাজ মানুষ

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৭ আগস্ট, ২০১৮

রমেন্দু সেন ::
জেলা প্রশাসকরা পরিযায়ী পাখিদের মতো। একটি জেলায় তাঁরা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে আসেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর চলে যান। সাধারণত এটাই প্রশাসনিক নিয়ম। এই নির্দিষ্ট সময়টির মেয়াদবিস্তৃতি তিন বছর। এরপর বদলি। কিন্তু তার ব্যতিক্রম যে হয় না বা একেবারে নেই, এমন নয়। ব্যতিক্রম অবশ্যই হয়। এই ব্যতিক্রমটাই যত্রতত্র, যখন-তখন চলছে। বাস্তবে কেউই কোনোস্থানে যথাবিহিত তিন বছরের মেয়াদ ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিকঠাক পূর্ণ করতে পারেন না। কোনও না কোনও কারণে হয় তিন বছরের কম কিংবা তিন বছরের বেশি সময় পর্যন্ত বহাল থাকেন। এই বহাল থাকার বিষয়টি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাটির নিয়ন্ত্রণভুক্ত বা নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত উভয় প্রকারের হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে তারতম্য হয় মাত্র। সাধারণ মানুষের স্বার্থ, সমগ্র জেলার স্বার্থ সেখানে বিবেচ্য নয়।
প্রশাসনে রাজনীতির হস্তক্ষেপ প্রায়ই সাধারণ মানুষের স্বার্থকে ক্ষুণœ করে। জনকল্যাণকামী জেলা প্রশাসক সব সময়ই সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। তাঁর উপস্থিতি বিশেষ বিশেষ দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী কিংবা দলের জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয় বিধায় তাঁরা তাঁকে বদলির তদবিরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং কোনও না কোন সময় বদলি নিশ্চিত হয়। তখন কারও কীছু করার নেই।
পুরো পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ আমলে মহকুমা থাকাকালীন পর্যন্ত সুনামগঞ্জে আসতেন মহকুমা প্রশাসকেরা। এখন আসছেন জেলা প্রশাসকরা। তাঁদের মধ্যে কতোজন পুরো মেয়াদ পর্যন্ত এখানে কর্মরত ছিলেন জানা নেই। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় তাঁদের সিংহভাগ মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই বদলি হয়ে গেছেন। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পরও বদলি হয়ে যাননি সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকদের মধ্যে এমন কেউ থাকলেও থাকতে পারেন। মেয়াদ পূর্তির আগে এবার বদলি হচ্ছেন জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম।
একটি জেলায় একজন জেলা প্রশাসক নিয়োগ প্রাপ্তির পর তাঁকে অবশ্যই সেই জেলার সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জেলাটি সম্পর্কে অন্তত প্রাথমিক একটি ধারণা নিতে হয়। এই প্রাথমিক ধারণা নিয়ে তারপর কাজে নামতে হয়। এই প্রাথমিক ধারণার মধ্যে যেমন থাকে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজজীবন, অপরাধ, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির জগৎ। একটি জেলার নিরিখে এইসব জটিল প্রসঙ্গকে উপলব্ধিতে নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতে বা বুঝে নিতে হলে কীছুটা হলেও সময় দরকার। এইসব বিষয়াদি বিবেচনাবহির্ভূত রেখেও বলা যায় যে, একটি জেলাতে একজন প্রশাসকের ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও মেধার নিরিখে তাঁর কাছ থেকে দেশের-দশের কিংবা রাষ্ট্রের উন্নয়নে সেবাপ্রাপ্তির সরকারি নির্ধারিত সময়সীমা করা হয়েছে তিন বছর। এর একটাই অর্থ তিন বছরে কোনও একজন জেলা প্রশাসক তাঁর সামর্থ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে সক্ষম হবেন। এদিক থেকে বিবেচনায় জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলামের মেধা ও কর্মদক্ষতানুসারে অন্তত আরো দুই বছর সুনামগঞ্জ জেলার কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে রাখতে পারতেন। দুর্ভাগ্য সুনামগঞ্জের যে, তাকে আমরা তাঁর পূর্ণমেয়াদ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারছি না।
সুনামগঞ্জে আজ পর্যন্ত অনেক মহকুমা প্রশাসক ও জেলা প্রশাসক এসেছেন। কিন্তু তাঁরা সকলেই এক মাপের, এক রকমের নন। তাঁরা সকলকেই কিন্তু সুনামগঞ্জের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন না, যেমন জেলার উন্নয়ন কাজে আবদানের উৎকর্ষতার বিচারে সুনামগঞ্জের ইতিহাসে মহকুমা প্রশাসক শামসুল আলম সিএসপি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ আলীর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দু’জন পূর্বসূরির পাশে তাঁদের উত্তরসূরি আর একজনের নাম যুক্ত হলো, সে নামটি জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম। কিন্তু কেন?
এমন করিতকর্মা জেলা প্রশাসক সুনামগঞ্জ পেয়েছে এই প্রথম। যে প্রশাসকের মধ্যে চিরন্তন প্রশাসকসুলভ অহমিকা কিংবা দাপ্তরিকতাসুলভ কোনও জটিলতা পরিলক্ষিত হয়নি মোটেও। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন অনায়াসে। জেলা প্রশাসক হিসেবে একজন কর্মকর্তার উদ্ভাবনী কাজের সীমা কতোটা পর্যন্ত সীমিত আমার জানা নেই। আর রাষ্ট্র ও সরকার তাঁর সেই উদ্ভাবনী সীমাকে কতোটা অনুমোদন করবে তাও জানা নেই। মনে করতাম জেলা প্রশাসকেরা সকলেই সৃষ্টিশীলতার বাইরে জীবন কাটাবেন, এটা তাঁদের প্রশিক্ষণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাঁরা দেশ-দশকে শাসন করবেন বটে কিন্তু দেশ-দশকে নিয়ে কোনও স্বপ্ন, যা কবিতার মতো সুন্দর ও স্বাধীন চিন্তা বিকিরণে প্রোজ্জ্বল, কখনও দেখবেন না। অর্থাৎ কোনওরূপ উদ্ভাবনী কাজে নিজেকে নিয়োজিত না হওয়ারই কথা। কিন্তু জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম সুনামগঞ্জের প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠার নতুন প্রকল্পের কাজে নিজেকে ব্যপৃত করে রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শের এতোদিনকার পিছনমুখো অভিমুখকে সম্মুখমুখো করে দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, জেলা প্রশাসকের পদটি একটি সৃষ্টিশীল কাজের জায়গা, একজন প্রশাসকের সেখানে স্বাধীনচেতা মানুষ হয়ে দাঁড়াবার জায়গা আছে। আসলে কেবল দরকার দেশের উন্নতিকে সামনে রেখে মন-মননে মুক্তচিন্তার একটুখানি চর্চার সঙ্গে সাকরেদিপনার পরিপূর্ণ পরিহার। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ প্রগতিশীলতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা নয়। স্বাধীনতার ৪৭ বছরের মধ্যে কারও মাথায় এই চিন্তার উদ্রেক হলো না, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া দেশ, এখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রাসঙ্গিকতা সবচেয়ে ইতিহাসসম্মত একটি সমাজবাস্তবতা। ইউনিয়নে ইউনিয়নে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠার প্রকল্প সুনামগঞ্জে বাস্তবায়ন করে সাবিরুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত সরকারি পুরস্কার অর্জন করেছেন। সরকার তাঁকে জনপ্রশাসন পদক দিয়েছেন।
তাঁর দেশপ্রেমের সমুন্নতির একটি উদাহরণ প্রকাশ পেল অতিসম্প্রতি তাঁর আর একটি কাজে। গত ২ আগস্ট তারিখের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি শিরোনাম ছিল, “জেলা প্রশাসকের আর একটি অনন্য উদ্যোগ ॥ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে এক হাজার কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ রোপণ শুরু”। গত মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ সদরের ডলুরা গণকবরে কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ রোপণ করে এই অনন্য কর্মসূচি তিনি শুরু করেন। পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছে, “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধগুলো লাল-সবুজে ছেয়ে দিতেই এই উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।” তাছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের গণকবর সন্ধান ও সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান চিহ্নিতকরণ এবং ট্যাকেরঘাটে মুক্তিযোদ্ধা উপত্যকা, সিরাজ লেক, সিরাজ কটেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিগত বৈশাখের আগের বৈশাখে সুনামগঞ্জে শতভাগ ফসল ডুবির ঘটনা ঘটেছিল। সাবিরুল ইসলামের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় গতবারের হাওরক্ষাবাঁধগুলো রক্ষা পেয়েছিল। তিনি তাঁর পুরো প্রশাসন নিয়ে কাজে নেমেছিলেন এবং প্রতিটি বাঁধ তৈরিতে অনিয়ম-দুর্নীতি রুখে দিয়েছিলেন। মনে করা হয়, তাঁর অনন্যসাধারণ দৃঢ়তা ও কাজের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলেছে।
বিদগ্ধদের কেউ কেউ বলেন, সত্যিকার অর্থেই অতীতের প্রশাসনিক রেওয়াজ তিনি পাল্টে দিয়েছেন। এই জেলায় যাঁরা চাকরি করতে আসেন তাঁদের সিংহভাগই প্রাপ্তিযোগে তৃপ্ত হয়েই প্রস্থান করেন, সুনামগঞ্জকে অঞ্জলিভরে দান করার সামর্থ্য তাঁদের অনেকেরই থাকে না। সাবিরুল ইসলাম তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম, মুক্তচেতনার ধারক এক স্বপ্নবাজ মানুষ। তিনি সুনামগঞ্জকে তাঁর মুক্তচেতনার কিরণসম্পাতে স্নাত করে গেলেন। একদিকে তাঁর কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতার সবুজ আর ফুলের লাল সুনামগঞ্জের প্রকৃতিতে রঙ ছড়াবে আর অন্যদিকে সুনামগঞ্জ তাঁকে জানাবে অভিবাদন।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com