রুমীন ফারহানা ::
আঠারো বড় দুর্বার, বড় ভয়ঙ্কর, এ বয়স থামতে জানে না, এ বয়স হিসাব বোঝে না, এ বয়স লাভ লোকসান চেনে না। গত কয়েকদিন যাবৎ রাজপথজুড়ে আঠারোর মেলা, কৈশোর আর সদ্য তারুণ্যে পা রাখা নির্ভীক কিশোর-তরুণের মেলা। বেশিরভাগই স্কুলছাত্র, কেউবা সদ্য স্কুল পেরুনো, আবার কেউ কলেজের চৌকাঠ ডিঙানো সদ্য তরুণ। সাদা হাফ শার্ট, গাঢ় নীল প্যান্ট, কাঁধে ব্যাকপ্যাক, সাহসী দৃষ্টি, দৃপ্ত পদক্ষেপ, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর কিন্তু ধৈর্যশীল বিনয়ী। তাদের শরীরের ভাষা ¯পষ্ট বলে দেয় তারা হারতে জানে না, আপস বোঝে না, বৈষম্য চেনে না। তারা শুধু বোঝে আইনের চোখে সবাই সমান, আইন মানতে সবাই বাধ্য।
নতুন দিনের স্লোগান তাদের কণ্ঠে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্লিশে হয়ে যাওয়া বস্তাপচা স্লোগানের ঘূর্ণাবর্তে আটকে আছে তখন তাদের কণ্ঠে ওঠে এসেছে নতুন দিনের গান ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’ কিংবা ‘৯ টাকায় ১ জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ চাই না, নিরাপদ বাংলাদেশ চাই’, ‘ঐড়ি সধহু ষরাবং ফড় ুড়ঁ হববফ ঃড় বহংঁৎব ঔঁংঃরপব, ‘বি ধিহঃ ঔঁংঃরপব’, ‘৪এ ¯িপড নেটওয়ার্কে নয়, ৪এ ¯িপড বিচার ব্যবস্থায় চাই’, ‘লোকাল বাস মানুষ খায়, নৌ মন্ত্রীর হাসি পায়’, ‘মুজিব কোটে মুজিবকেই মানায়, চামচাদের নয়’, ‘রাস্তা বন্ধ, রাষ্ট্রের মেরামত চলছে’।
দেশজুড়েই ট্রাফিক নৈরাজ্য বহু পুরনো সমস্যা আমাদের। আমরা পারিনি এর সমাধান করতে, এমনকি সমাধানের কোনও দৃশ্যমান উদ্যোগও নেইনি কোনও দিন। সড়কে মৃত্যুর মিছিল। সয়ে যাওয়া চোখ, মন আর মস্তিষ্কের কোথাও আঘাত হানেনি আমাদের। স্বজনের অকাল মৃত্যু অমোঘ নিয়তি বলে মেনে নিয়েছি, যেন মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিলে যোগ হয়েছে একটি সংখ্যা মাত্র। কিন্তু অভাবনীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছে সদ্য কৈশোরে পা রাখা এই নতুন প্রজন্ম। ৪/৫ দিনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এ অচলায়তন ভাঙা যায়। বুঝিয়ে দিয়েছে কতটা অনিরাপদ অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে পথে নামি আমরা।
অতি সাধারণ নাগরিকের গাড়ি যেমন থামিয়েছে তারা, তেমনি থামিয়েছে উল্টোপথে চলা মন্ত্রীর গাড়ি, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের গাড়ি, বিচারপতি, ডিআইজি নেভাল পুলিশের গাড়ি, বিজিবি কর্মকর্তা, ডিবি পুলিশ, পৌরসভা চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, সরকারি আমলা, ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি, অনেকটা বাছবিচারহীনভাবেই। দেখা গেছে দেশের বড় বড় কর্তাব্যক্তিদের গাড়িচালকের লাইসেন্স নেই। কারও গাড়ির ফিটনেস নাই। তারা বাধ্য করেছে মন্ত্রীকে উল্টোপথ থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে সোজাপথে চলতে, বাধ্য করেছে লাইসেন্সবিহীন গাড়ি বদল করতে। এ যেন এক নতুন বাংলাদেশ। বুঝিয়ে দিয়েছে গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করা যায় না। পচন ধরেছিল অনেক আগে, ওরা ঝাঁকুনি দিয়ে স্মরণ করিয়ে গেলো আবার।
বিআরটিএ’র তথ্যানুযায়ী দেশে ১ লাখের বেশি যাত্রীবাহী বাস আর পণ্যবাহী ট্রাকের ফিটনেস সনদ নেই। আর একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধান বলছে, সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এসব গাড়ি নিয়মিতভাবে সরকারি কোষাগারে বার্ষিক ফি আর ট্যাক্সও জমা দেয় না। এমনকি তারা রাস্তায় চলাচলের উপযোগী কিনা তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো রাস্তায় চলাচলরত ১৬ লাখ যানবাহনে নেই কোনও বৈধ লাইসেন্সধারী চালক। লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ ড্রাইভারের হাতে দুর্ঘটনা ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক। এছাড়া ফিটনেস আর লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেও আছে অরাজকতা, দুর্নীতি। ত্রুটিপূর্ণ লাইসেন্স ব্যবস্থা আর যেনতেন প্রকারে ফিটনেস সনদ পুরো ব্যবস্থাটিকে করেছে চূড়ান্ত রকমের প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থাৎ গাড়ির ফিটনেস আছে কিংবা চালক একটি বৈধ লাইসেন্সের মালিক সেটাই যথেষ্ট নয়।
ব্র্যাকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে তার ৬৮.৪১ শতাংশের পেছনে বাস আর ট্রাক জড়িত। দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি আর ৩৭ শতাংশ ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। তারেক মাসুদ কিংবা মিশুক মুনীরের মতো প্রতিভা আমরা হারিয়েছি সড়ক দুর্ঘটনাতেই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, ২০১৭ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত হয়েছেন আর আহত হয়েছেন ১৬ হাজারের বেশি। আর একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকের সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের প্রথম ৬ মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৪৭১। গত সাড়ে তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৫ হাজার ১২০ জন। বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। দেশ বছরে হারাচ্ছে জিডিপি’র ২-৩ শতাংশ। এই ক্ষুদ্র পরিসংখ্যানই যথেষ্ট পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য। নির্বিকার বেপরোয়া চালক জানে পরিবহনের মালিক শ্রমিক সকল সংগঠন আছে তাদের সাথে। যে সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণে আবার আছে সরকারের মন্ত্রী, এমপি মাপের লোকজন। কিছু হলেই যানচলাচল বন্ধ রেখে মানুষকে জিম্মি করা খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে তারা।
নিরাপদ সড়কের এই আন্দোলন চলমান থাকা অবস্থায় ঘটে গেছে আরও কয়েকটি দুর্ঘটনা, প্রাণ হারিয়েছে আরও কিছু নিরপরাধ মানুষ। শুধু তাই নয়। এই আন্দোলন চলা অবস্থায় যাত্রাবাড়িতে লাইসেন্স দেখতে চাওয়ায় ছাত্রদের ওপর পিকআপ চালিয়ে দেওয়া হয়। বিস্ময়ে প্রশ্ন জাগে, এই সাহস তারা পায় কার মদতে! এরই মধ্যে এই ন্যায্য আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার এর মাঝে খুঁজতে চাইছে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীতো ¯পষ্টই বলেছেন এই আন্দোলন ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে পারে, স্যাবোটাজ হতে পারে। বলেছেন এরপর কিছু ঘটলে পুলিশ তার দায় নেবে না। যৌক্তিক ও ন্যায্য এই আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হিসাবে কোনও ঘোষণা ছাড়াই বৃহ¯পতিবার থেকে দূরপাল্লার বাস বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ এ ধরনের কর্মকা-ের শাস্তি রাস্তায় গাড়ি চলাচলের অনুমোদন বাতিল।
শিক্ষার্থীদের এই ক্ষোভ হঠাৎ একদিনে তৈরি হয়নি। যদিও এটা সত্য যে এক শাজাহান খানের ‘বীভৎস’ হাসি পুরো বিষয়টিকে উসকে দিয়েছে কয়েকগুণ। রাস্তায় দিনের পর দিন ঘটেছে নৃশংস সব হত্যাকা- কিন্তু দৃশ্যমান কোনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি সরকারকে। শিক্ষার্থীরা যে আজ সরকারের আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে পারছে না তার জন্য দায়ী সরকারের অতীত কর্মকা-।
এই ফাঁকে বলে রাখি, সড়ক মহাসড়কে যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী গত জুনে ৫টি নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় তিন মন্ত্রীকে। মাস পেরিয়ে গেলেও নির্দেশনা বাস্তবায়নে তিন মন্ত্রী আজ অবধি একটি বৈঠকও করেননি।
আন্দোলনের মূল স্লোগানগুলোর একটি হলো ‘ডব ধিহঃ লঁংঃরপব’। কথাটির ব্যাপকতা অনেক। সরকারের উচিত হবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের চোখের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করা। বল প্রয়োগে আন্দোলন দমনের চেষ্টা হবে ভুল। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সরকার এ ধরনের ভুল করবে না বলেই আশা রাখি।
[লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট]