‘দেড় দশকেও টাঙ্গুয়ার সুরক্ষা হয়নি’। এমন ‘ভয়ঙ্কর’ সংবাদশিরোনাম বোধকরি এই পত্রিকার জীবনে এটাই প্রথম। ভয়ঙ্কর এজন্য যে, টাঙ্গুয়ার মতো একটি বিশ্ববিখ্যাত হাওরকে আক্ষরিক অর্থেই মেরে ফেলা হচ্ছে কথিত সংরক্ষণের নামে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সংরক্ষণের নামে ওই সময়ে অবাধে মাছ ধরা, গাছ কর্তন, পাখি শিকারসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনায় টঙ্গুয়ার জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে বলে এলাকাবাসীর ধারণা।’ গত ১৫ বছরে যা ঘটেছে সে-সম্পর্কে সাধারণ মানুষের এই ধারণা শুধু শুধু ধারণা নয় বরং এটাই বাস্তবিক সত্য। ‘অবাধে মাছ ধরা, গাছ কর্তন, পাখি শিকারসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা’ টাঙ্গুয়ায় ঘটেই চলেছে। পুরনো ইজারা প্রথায় অন্তত এইসব হাওরের জীববৈচিত্র্যবিরোধী অপরাধ এমন অবাধে ও ব্যাপকাকারে সংঘটিত হতো না। ইজারাদাররা তাঁদের মুনাফার স্বার্থে এসব অপরাধ ঠেকিয়ে রাখতেন এবং স্বউদ্যোগে বনসৃজন করতেন মাছের বংশবৃদ্ধির সুবিধা পাওয়ার আশায়। দেখেশোনে মনে হচ্ছে, এখন এসব অপরাধ বরং উৎসাহিত হচ্ছে।
রোগীকে যেমন ব্যবচ্ছেদ করতে অপারেশন টেবিলে তোলে চিকিৎসকরা কাটা-ছেঁড়া করেন তেমনি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার অজুহাতে টাঙ্গুয়াকে আসলে ‘জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ’ নামক প্রকল্পের টেবিলে তোলে কাটা-ছেঁড়া করে হাওরটির প্রকৃতিগত মৃত্যুকে সুনিশ্চিত করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, টাঙ্গুয়া এমন একটা প্রাকৃতিক সম্পদ যেখানে এক কোটি বিশ লক্ষ বছর আগের প্রাকৃতিক অবস্থা বা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত আছে। এই বিশ্বঐতিহ্যকে এখানে সরকারি ছত্রছায়ায় কয়েকটি টাকার জন্য বিনষ্ট করতে দেওয়া সমীচীন হবে না। সরকারি ছত্রছায়ায় বলছি এজন্য যে, গত ১৫ বছরে সরকারি তহবিল থেকে একশত কোটি টাকা খরচ হয়েছে, টাঙ্গুয়ার জীববৈচিত্র্য রক্ষার খাতে, অথচ টাঙ্গুয়ার জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে প্রচুর এক রত্তি পরিমিত উন্নতি হয়নি। পুরনো ইজারা পদ্ধতিতে ইজারা দিলেও সরকারি রাজস্ব আদায় হতো হাজার কোটি টাকা। এখন নতুন ইজারা পদ্ধতি চালু হয়েছে। গত ১৫ বছর ধরে হাওরের বিভিন্ন বিল বা জলাশয় ঘণ্টাভিত্তিক ইজারা দিয়ে মাছ মেরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে পুরনো ইজারা প্রথার দোষ কী? বোধ করি দোষ একটাই, পুরনোটা ইজারা প্রথাটিকে আধুনিক পুঁজিবাদের পছন্দ নয়, তার চাই ঘণ্টাভিত্তিক ইজারা, আরও বেশি করে হাওরকে শোষণ করে বেশি বেশি মুনাফা। এই বেশি মুনাফার জন্য টাঙ্গুয়া যদি মরে যায় তো মরে যাক, তাতে পুঁজিবাদের কোনও আপত্তি নেই। পুঁজিবাদ এমনই ভয়ঙ্কর। পুঁজিবাদ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে প্রতিনিয়ত। এই ধ্বংসের ভয়াবহতা এতোদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে একটি মৃত্যুপথযাত্রী গ্রহ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তাঁরা মনে করেন, অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে তাই বাঁচার জন্য অন্য গ্রহে শরণার্থী হতে হবে।
আমরা আশা করবো, সরকার টাঙ্গুয়ার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি নিয়ে ভাববেন এবং অচিরেই টাঙ্গুয়াকে রক্ষার নামে ধ্বংস করার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবেন। অন্যথায় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুরবস্থার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প হাওরাঞ্চলের মানুষদের জন্য আপাতত লক্ষ করা যাচ্ছে না।