‘বাল্যবিবাহমুক্ত এলাকা’ বলে একটা সামাজিক প্রপঞ্চের প্রসঙ্গ সম্প্রতি প্রায়ই বিদ্বৎজনের আলোচনার অংশ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সভা-সমিতির আলোচনায় এই শব্দজুটসম্পন্ন শব্দটির প্রাসঙ্গিকতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এখন বোধ করি এইরূপ আর একটি প্রপঞ্চ ‘আগাম বন্যাসহিষ্ণুতা’র প্রতিরূপে পূর্বেকার ‘আগাম বন্যাপ্রতিরোধ’-এর প্রাসঙ্গিকতাকে ছাপিয়ে উঠতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে, বিশেষ করে সুনামগঞ্জে, ‘আগাম বন্যাপ্রতিরোধ’-এর প্রসঙ্গটি এলাকার সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে স্বহস্তের রেখার মতো সুপরিচিত, কিন্তু ‘আগাম বন্যাসহিষ্ণু এলাকা’ প্রপঞ্চটি একেবারেই পরিচিত নয়। একটিতে আছে যে-করেই হোক আগাম বন্যা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা, অর্থাৎ বন্যাকে প্রতিরোধ করার প্রাযুক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ, সেখানে বন্যাকে সহ্য করার মতো দুর্বলতার কোনও অবকাশ নেই। বিপরীতে ‘আগাম বন্যাসহিষ্ণু এলাকা’ প্রপঞ্চটির মধ্যে বন্যাকে প্রতিরোধ করা নয়, বরং বন্যাকে সহ্য করা’ অর্থাৎ বন্যার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, প্রকারান্তরে বন্যার সঙ্গ বসবাসে অভ্যস্ত হওয়া, মোটকথা বন্যার কাছে একধরনের আত্মসমর্পণ করার বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। এই বন্যাসহিষ্ণুতার নিহিতার্থ হতে পরে ফসলহানির পর তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা।
গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, “হাওরাঞ্চলকে আগাম বন্যাসহিষ্ণু এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।” এই গড়ে তোলার কথাটি একজন মন্ত্রীর উচ্চারণ। কিন্তু হাওরাঞ্চল সম্পর্কে জানা কথা এই যে, হাওরাঞ্চল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বন্যা সইতে সইতে বন্যাসহিষ্ণু হয়েই গড়ে উঠেছে। এই অঞ্চলটিকে নতুন করে ‘বন্যাসহিষ্ণু এলাকা’ করে তৈরি করার নির্গলিতার্থ একটাই, এই অঞ্চলে আলাদা করে কোনও কাজ করতে হবে না। প্রকৃতি তো এই অঞ্চলটিকে আগে থেকেই বন্যাসহিষ্ণু অঞ্চল করেই গড়ে তোলেছে। বন্যাবিষয়ে এখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে মানুষের আলাদা করে কোনও কীছু করার সুযোগ নেই। বন্যাসহিষ্ণুতা সৃষ্টির জন্যে তো স্বয়ং প্রকৃতিই একপায়ে খাড়া আছে। বন্যাসহিষ্ণুতার বিষয়ে সুনামগঞ্জের ভালো দীক্ষাগুরু কেবল প্রকৃতি, অন্য কেউ নয়, মানুষ এটা পারে না।
তাই বলি, ভাটি অঞ্চলকে নতুন করে ‘আগাম বন্যাসহিষ্ণু এলাকা’ করে গড়ে না তোলে ‘আগাম বন্যা প্রতিরোধসম্পন্ন এলাকা’ করে গড়ে তুলুন। সুনামগঞ্জ বন্যাকে সহ্য অনেক করেছে, সেটা একটা মান্ধাতার আমলের পুরনো প্রপঞ্চ, সুনামগঞ্জের কাছে ডালভাত। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এদেশে নতুন কোনও ঘটনা নয়। দেশিবিদেশি মুজিববিরোধীচক্রের চক্রান্তে সৃষ্ট চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ঘটনা এদেশের মানুষ ভুলে যায়নি এবং বাংলাদেশ পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েও যায়নি। মনুষ্য প্রযতেœ সেই ঘটনার সৃষ্টি করে খাদ্যনিরাপত্তহীনতায় ভোগার চেয়ে বন্যাকে প্রতিরোধ করা উত্তম। সুনামগঞ্জ বন্যাকে প্রতিরোধ করতে চায় বন্যাকে সহ্য করতে চায় না। তাই আহ্বান রইলো, ‘বন্যাসহ্য করা’র নেতিবাচকতা পরিহার করুন।