সম্প্রতি ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের একটি নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সে-সংগঠনটির অনুষ্ঠানের আলোচনায় অংশগ্রহণকারী প্রথিতযশা বক্তারা বাংলাদেশকে কক্ষপথচ্যুত বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য এই কক্ষপথচ্যুতি তাঁরা নির্ধারণ করেছেন দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধারাবাহিক অবক্ষয়ের নিরিখে। তাঁরা মনে করেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই অবক্ষয় ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে চ্যুত করছে দেশকে এবং দেশকে পুনরায় সেই ধর্মনিরপেক্ষতার পথে ফিরিয়ে নিতে হবে। সংক্ষিপ্ত সংবাদপ্রতিবেদনে উদ্ধৃত যৎসামন্য বক্তব্য থেকে অন্তত তেমনটিই অনুমিত হয়। একজন তো পরিষ্কার করেই বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে বিভাজনের উপাদান তিনটি- ধর্ম, রাজনীতি ও ব্যক্তিস্বার্থ। সেই বিভাজন দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল বায়বীয় বাচনিক উচ্চারণের মাধ্যমে নয়, সক্রিয় কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশকে কক্ষপথে ফিরিয়ে আনতে হবে।’
দেশের এই ‘কক্ষপথচ্যুতি’র সঙ্গে কোনও দ্বিমত পোষণ করছি না। কক্ষপথ থেকে দেশ বিচ্যুত, তা মেনে নিয়েই বলতে চাই এই কক্ষপথটি ধর্মনিরপেক্ষতার পথ নয়, অন্যকোনও কক্ষপথ। ধর্ম, রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ মানুষের মধ্যে ছিল, আছে এবং থাকবে। এগুলোর সমাজের নিয়ন্ত্রক নয়, বরং অর্থনীতির উপজনন কিংবা প্রকটিত লক্ষণ। লেলিনের ‘ধর্মের শুকিয়ে মরার’ তত্ত্ব কার্যকর হওয়ার সময়টি বোধ করি অসীম। আপাতত এখানে ‘ধর্মের শুকিয়ে মরা’ নিয়ে কথা বলার কোনও অবকাশ নেই। ‘মানুষের মধ্যে বিভাজনের উপাদান তিনটি- ধর্ম, রাজনীতি ও ব্যক্তিস্বার্থ’ যেমন ছিল, যেমন আছে, তেমন থাক। কীছু আসে যায় না। আসল কথা হলো দেশে কোন অর্থনীতি কার্যকর আছে। অনুসৃত অর্থনীতি যদি মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি না করে তবেই হলো। আর্থনীতিক বিভাজনই মূলত ‘ধর্ম, রাজনীতি ও ব্যক্তিস্বার্থ’জাত বিভাজন তৈরি করে, এমনকি ধর্মকে রক্ষা করে তৈরি করে ধর্মনিরপেক্ষতাও। ধর্মনিরপেক্ষতা নিরসনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে, অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার মরীচিকার পেছনে ধাওয়া না করে, আর্থনীতিক বৈষম্য নিরসনের অর্থনীতি চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। আগে চাই অর্থনিরপেক্ষতা, তা হলেই মিলবে কাক্সিক্ষত ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদয়িক সম্প্রীতি। অর্থনিরপেক্ষতাই ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পূর্বশর্ত।