নারী ও শিশু নির্যাতন রোধকল্পে সচেতনতা ও করণীয় শীর্ষক একটি কর্মশালা হয়ে গেল সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা মিলনায়তনে। বাংলাদেশে বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন অতীতের যে-কোনও সময়ের তুলনায় ব্যাপকাকার লাভ করেছে। এর ভয়ঙ্করতার বর্ণনা করা ভাষাতীত। কুমিল্লা সেনানিবাসে তনু হত্যার কথা স্মরণ করা যাক। ধর্ষণের পর হত্যা। তাকে একটি ঝোপের ভেতর ফেলে রাখা হয়েছিল। পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়েছে, আলামত নষ্ট করার প্রচেষ্টা হিসেবে সে ঝোপটির আগাছাশুদ্ধ ভূত্বকের ইঞ্চি ছয়েক মাটি তোলে নিয়ে অন্যত্র ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ময়নাতদন্ত নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কারসাজিসহ সমাজের কোনও-শ্রেণি স্তরের মানুষ তনুর বিচার পাওয়ার পক্ষে দাঁড়াতে পারেনি। নারীদের মতোই শিশুরাও নিরাপদ নয়। একটি বারো/তোরো বছর বয়সের মেয়েও একদিকে যেমন শিশু অন্যদিকে সে নারীও বটে। অনেক ক্ষেত্রে সে দলধর্ষণের কোন বিচার পায় না। উল্টো ধর্ষকদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে গ্রাম ছেড়ে গিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়। প্রশাসন, গ্রাম পঞ্চায়েত, সমাজের পাঁচজন কেউই তার পক্ষে দাঁড়ায় না। একটি শিশুকে জিম্মি করে টাকা চাওয়া হয়। টাকা না পেয়ে শিশুটিকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। একটি মেয়ে ইভটিজিংয়ের অত্যাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে। অথচ মেয়েটিকে যে বা যারা নির্যাতন করেছে তারা এই সমাজেরই বাসিন্দা। এই সমাজের চোখের সামনেই সে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে। সে বিচারপ্রার্থীও হয়েছে এই সমাজের কাছে। কিন্তু বিচার পায়নি।
এইসব ঘটনা প্রমাণ করে সমাজ ও সভ্যতা আসলে প্রয়োজনে নারী ও শিশুর প্রতি কতোটা হিং¯্রতা দেখাতে পারে। যে সমাজ তার শিশু ও নারীকে রক্ষা করতে পারে না, সে-সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। অর্থনীতির বিচারে বাংলাদেশ গরিব দেশের কাতার ছেড়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হয়ে পড়েছে। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন রোধকল্পে সচেতনতা ও করণীয় শীর্ষক কর্মশালা’ করার তাগিদ যখন বোধ করেন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় এবং সেখানে কর্মশালায় যে-সব প্রসঙ্গ আলোচিত হয় আর দেশের যে বাস্তব অবস্থার চিত্র প্রকট হয়ে উঠে, সে চিত্রের নিহিতার্থ উপলব্ধি করার পর স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের উন্নত দেশের কাতারে শরিক হওয়ার বাস্তবতাটি অর্থহীনতায় পর্যবশিত হয়। একদিকে দেশ খুব উন্নত হলো অন্যদিকে দেশের শিশু ও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলো না। এই উন্নয়নের কী কোনও মানে হয়, না মানে থাকবে? আসলে এই সমাজকে রক্ষা করার একটি কর্মসূচির মতো একটা কীছু কিংবা পচনকে সারিয়ে তোলার একটা প্রচেষ্টা অনেকটা মলম লাগানোর মতো কীছু করে কোনও লাভ নেই। এই সব করে সচেতনতা বাড়িয়ে, উপদেশ খয়রাত করে কীছু হবে না। আসল কথা, এই সমাজকেই আমূল বদলে দিতে হবে। বদলে দিতে হবে অর্থনীতিকে। অর্থনীতিটিকে হতে হবে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে সহায়ক। অর্র্থনীতিটাই হতে হবে নারী ও শিশু নির্যাতন বিনাশে কার্যকর। অর্থনীতি মুনাফামুখি হলে শিশুশ্রম ও নারীশ্রম শোষণ বন্ধ হবে না, নির্যাতন বাড়বেই। অর্থনীতি বদলে গেলে সংস্কৃতি বদলে যাবে। সমাজে শিশু ও নারী নির্যাতক থাকবে না।
শিশু ও নারী নির্যাতন বিরোধী কর্মশালা বাস্তবায়নে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়কে ধন্যবাদ। তাঁরা অন্তত এই ঝিমিয়ে পড়া সমাজকে জাগানোর জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।