ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঈদ-উল-ফিতর আমাদের দেশ তথা সারা বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব। বছর পরিক্রমায় আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে পৃথিবীর জীর্ণ কুটির হতে রাজপ্রাসাদে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের কাছে। ঈদ সাধারণত চান্দ্র মাসের হিসাবে হিজরী অনুসরণ করে পালিত হয়ে থাকে। চান্দ্র মাস যেহেতু চন্দ্র উদয়-অস্তের সাথে হিসাব করা হয়, সেজন্য রমজান মাস পৃথিবীর একেক দেশে একেক দিন শুরু হয়। ঠিক তেমনি আনন্দ আর খুশির বন্যা নিয়ে বয়ে আসা ঈদও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একদিন, দুইদিন, আগে পরে উদযাপিত হয়ে থাকে। একদিনে সারা পৃথিবীর মুসলিম, আমরা যারা আছি সবাই যদি একসাথে ঈদ উদযাপন করতাম, একই সাথে কোটি কোটি মানুষ ঈদের জামাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহকে সিজদা করতাম তবে আমার মনে হয় বিশ্ব মুসলিমের ভাতৃত্ব আর একতা বাড়তো। সেই সাথে ঈদের মহিমা আরো মহিমান্বিত হতো। কিন্তু ধর্মের বিধানতো এটাই, হয়তো মহান আল্লাহ-তাআলার অসীম কল্যাণের কোনো অনন্ত মঙ্গলময় রহস্য এর ভিতর অন্তর্নিহিত রয়েছে। যা বুঝবার ক্ষমতা বা শক্তি-জ্ঞান আমাদের নেই। আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছেন যারা সৌদিআরব যেদিন ঈদ হয় সেদিন তারা ঈদ উদযাপন করে থাকেন। তাদের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন থাকবে- বড় বড় খ্যাতনামা আলেমদের নিয়ে সরকারি তত্ত্বাবধানে চাঁদ দেখার কমিটি রয়েছে তারা চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ঈদ উৎসব পালনের সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। তাদের তথা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে যদি একই সাথে বাংলাদেশেও একই দিনে ঈদ উৎসব পালন করি তাহলে আমাদের ঐক্য আরো সুদৃঢ় হবে, ঈদ উদযাপন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি দূর হবে। অবশ্য এটা যার যার ঈমান আকীদার ব্যাপার। মাহে রমজান মাসে আল্লাহ-তাআলার বিধান অনুযায়ী, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, নিজেদের আত্মশুদ্ধির জন্য রোজা পালন করে থাকি। একনিষ্ঠ মনে আল্লাহর ইবাদাত করে থাকি। যা কবুলের মালিক একমাত্র আল্লাহ-তাআলা। রোজা শুধু সেহেরি খাওয়া আর সারাদিন উপোস থাকার পর পেটপুরে ইফতার খাওয়া নয়। রোজার আরেকটি প্রধান অঙ্গ হলো সংযম। রোজা রাখলাম, আর মানুষকে কষ্ট দেওয়ার জন্য অবৈধভাবে জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা লুটলাম, পরনিন্দা বা গীবত করলাম, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মানুষকে হয়রানি করে ঘুষ খেলাম, হারাম উপার্জন করে সেই টাকায় ইফতার করলাম, মিথ্যা বলে লোক ঠকালাম, টিভিতে অশ্লীল প্রোগ্রাম দেখে সময় কাটালাম, মানুষের ন্যায্য হক মারলাম; নিজের স্ত্রী আর বিবাহযোগ্য মেয়েদেরকে হাই হিল জুতা আর হাত কাটা, পেট কাটা, জামা পরিয়ে বিভিন্ন বিপণিতে পুরুষদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ঈদের লেটেস্ট ফ্যাশনের জামা কাপড় কিনতে পাঠালাম, পাশের বাড়ির লোক খেয়েছে কিনা তা খোঁজ না নিয়ে বড় বড় ইফতার পার্টি করলাম, যা আমরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে করে থাকি। আল্লাহ-তালা তাদের ক্ষমা করুন, তাদের রোজা কবুল করুন।
যাক আজেবাজে কথা লিখে সুহৃদ পাঠক আপনাদের বিরাগভাজন হতে চাইনা। তবে ঈদের আনন্দ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে উপভোগ করা কতো যে আনন্দের তা কমবেশি সবারই জানা আছে। ঈদের দিন ধনী-গরিব, আমির-ফকির সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ শেষে কোলাকুলি করেন ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে গিয়ে কেউ খান কাচ্চি-বিরানী আর কেউবা মরিচ পোড়া দিয়ে আলুভর্তা আর ভাত। কেউ পরেন ছেঁড়া তালি দেওয়া পাঞ্জাবি আর কেউবা পরেন হাজার হাজার টাকায় কেনা পাঞ্জাবি। বিশেষ করে টিভির পর্দায় জনদরদী নেতারা টকশোতে বড় বড় নীতিকথা, আর ঈদের মাহাত্ম্য নিয়ে বুলি আওড়ান, তারা যদি একটু ত্যাগের মনোভাব নিয়ে তার কাপড়টি স্বল্প মূল্যে কিনে বাকি টাকা দিয়ে গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন তাহলে তার একটি পাঞ্জাবির দামে বিশ-ত্রিশ জন মানুষ নতুন কাপড় পরতে পারতো। তাদের মুখে অনাবিল আনন্দ ফুটতো। আমাদের দেশেতো উচ্চবিত্ত মা-বোনদের অনেকেই নাকি প্রতিযোগিতা করে সিঙ্গাপুর, হংকং, ভারতে ঈদের শপিং করতে যান। উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের স্ত্রী ও আদরের দুলালীরা নাকি ম্যাচিং করে শাড়ি হতে জুতা, কসমেটিকসের স্তূপে ঘর ভরে তুলেন। তারা নাকি মনে মনে দোয়া করেন, ঈদের দিনটি চব্বিশ ঘণ্টা না হয়ে বাহাত্তর ঘণ্টা লম্বা হলে ভালো হতো। যাতে করে তাদের ঈদ উপলক্ষে কেনা হরেক রকম বিভিন্ন ফ্যাশনের অগণিত জামাগুলো অন্তত একবার করে পরতে পারেন। অথচ আমাদের মহান ধর্ম ইসলামে কিন্তু এরকমটা সমর্থন করে না। ফ্যাশনের নামে নগ্নতা, বাহারী পোশাকের প্রদর্শন ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আপনার মতো একজনের নির্লজ্জ প্রদর্শনের ব্যয়ে অনেক হতদরিদ্র ঈদের খুশিতে শরীক হতে পারতো। ইসলামের মূল মন্ত্র “ভোগে নয় ত্যাগে” আসুন না সবাই একটু ত্যাগী হই। নামাজ-রোজার মতো যদি হিসেব করে যাকাত প্রদান করি তাহলে দেশের অনেকেই হয়তো গরিব থাকবে না। ঈদের দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে খোদার আরশ কাঁপাবেন না। অনেকেই হয়তো মনে মনে আমাকে বলছেন- ভ- বহু বড় বড় কথা বলছো, আগে তুমি নিজে ঠিক হও তারপর আমাদেরকে বলো। আমি নিজেও এই অপরাধে অপরাধী। তবে আল্লাহ মহান, তার দয়ার ভা-ার অসীম-অফুরান, যদি সাদা মনে আল্লাহর নিকট অপরাধের জন্য ক্ষমা চাই তবে মাফ পেয়েও যেতে পারি।
তাত্ত্বিক আলোচনা ছেড়ে এবার আমি আমরা ছোটবেলা কিভাবে ঈদ উদযাপন করতাম সে বিষয়ে খানিকটা লিখতে চাই। আমাদেরকে সাধারণত ঈদ-উল-ফিতরে নতুন জামা দেওয়া হতো। বহু অনুনয়ের পর ঈদে নতুন কাপড় কিনে দেওয়ার অঙ্গীকার করানো হতো বাবা-চাচাদের। ঈদের দশ-পনেরো দিন আগে যখন কোনো একদিন বাবার মুখ খুশিতে ভরা থাকতো সেদিন আমাদের ভাই-বোনদের সাথে নিয়ে কাপড়ের দোকানে যেতেন। সেখানে আমাদের নিজস্ব পছন্দের কোনো মূল্য ছিল না। আমাদের বড় চাচার কাপড়ের দোকান ছিল। তিনি তার কর্মচারীদের বলতেন ভালো টেকসই কাপড় দেখে যেন আমাদের জন্য পোশাক বানানো হয়। রং যাই হোক, আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক। কাপড়ের সুতা দেখে টেকসই যাচাই করে মনাই বাবু টেইলারকে দিয়ে মাপ নেওয়াতেন। তারপর থেকে শুরু হতো মনাই বাবুর দোকানে কাপড় আনার জন্য হাঁটা। সেকালে বাজারের, বিশেষ করে ঈদের সময় টেইলারবৃন্দ এবং কাপড় ইস্ত্রি ও ধোয়ার জন্য বাবু লালের যে গুরুত্ব ছিল তা দেখে মনে হতো তাদের মতো পাওয়ার ফুল মানুষ বুঝি আর নেই। বহু হাঁটাহাঁটির পর মনাই বাবুর করুণায় নতুন জামা তার দোকান হতে ডেলিভারি নিয়ে ভাঁজ করে আমরা বালিশের নিচে রাখতাম। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভাঙলে নতুন কাপড়ের গন্ধ শুকে প্রাণ জুড়াতাম। ভোর হতে নদীর পাড়ে শুরু হতো চিল্লাচিল্লি আর গোসল করার প্রতিযোগিতা। সকালে চোখে সুরমা আর আতর মেখে তৎকালীন সময়ে হান্দেশ, হাছারুটি আর নারিকেল সমসা খেয়ে ঈদের জামাতে যেতাম। ঈদের দিনে একটু অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়-স্বজনদের বেশি বেশি সালাম করতাম কারণ সেলামির টাকা। সেই টাকা দিয়ে সবেধন নীলমণি নূরজাহান সিনেমা হলে হুড়াহুড়ি, মারামারি করে লাহোরী অথবা বোম্বাইয়া সিনেমা দেখার পর ঈদের আনন্দ পূর্ণ হতো। ঈদের দিন ম্যানেজার সাহেবের ঠাট দেখে মনে হতো যেন তিনি সিনেমা হলের ম্যানেজার নন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান।
[লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, সহ-সভাপতি, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ।]