1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

আমচোর শিশুটি এবং ইত্যাদি : ইকবাল কাগজী

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৩ জুন, ২০১৮

গত কদিন আগের ঘটনা। সেদিন দুপুরের দিকে বাসায়ই ছিলাম। গিন্নি দিবা নিদ্রায় নিমগ্ন ছিলেন, আমি কম্পিউটারে। হঠাৎ মনে হলে উঠোনে কীছু একটা হচ্ছে একান্ত চুপিসাড়ে। ফিসফাস কণ্ঠের ক্ষীণ শব্দ আসছে। উঠে বাইরে গেলাম এবং দুই শতাংশের উঠোনটিতে তিনটি শিশুর উপস্থিতি আমাকে সচকিত করে তোলল। একজন আছে একেবারে বাসার প্রবেশ পথের কাছাকাছি, একজন উঠোনের মাঝ বরাবর, অন্যজন একেবারে বাসার পূর্বদিকের গাছগাছালির তলায়। সেখানে একটি ছোটখাটো আমগাছের নিচে সে দাঁড়িয়ে। আমগাছটার দুয়েকটি ডাল এতোই নিচু যে, মাটি থেকে মাত্র দেড় দু’ফুট উঁচুতে ঝুলে আছে বেশ ক’টা আম সমেত। বারান্দার গেট খোলে উঠোনে বেরিয়েই, ‘এখানে কী হচ্ছে?’ বলতেই তিনজনেই ঘাবড়ে গিয়ে হতবাক। আমগাছের নিচের ছেলেটির হাত থেকে দু’টি আম ছেড়ে দিল স্পষ্ট দেখতে পেলাম। খুব রাগ হলো এবং তখনি ছোট বাচ্চার কথা মাথায় এলো এবং নিজেকে সামলে নিলাম। তিনজকে তো একসাথে ধরা যায় না। বছর পাঁচেকের ‘আমচোর’কে ধরলাম। বহরে তার অপরাধই বড়। ধরতেই সে তার হাত ছাড়িয়ে নিতে প্রযতœ করার সঙ্গে সঙ্গে কাচুমাচু মুখে বললে, ‘সরি আংকেল’।
ছেলেটির মুখে ভাষাসাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার গন্ধ পেলাম। বাঙালির ছেলের মুখে বাংলা নয়, ইংরেজি বুলি। একটি অপ্রস্তুত মুহূর্তে তার মুখে তো মাতৃভাষা শোভা পাওয়ার কথা। ইংরেজি কেন? অবাক লাগলো। এই ইংরেজি বুলি তো ছেলেটির সাংস্কৃতিক মানে উৎকৃষ্টতার কোনও পরিচয় জ্ঞাপন করছে না। এই মুহূর্তে সে তো চুরি করে মালেবর্গায় ধরা পড়েছে। তার পরিবার তাকে ইংরেজি দু’টি শব্দ শিখানোর সঙ্গে চুরি করাও শিখিয়ে দিয়েছে, চুরি করা ঠিক নয় শেখাতে পারেনি। ভাবলাম এই ছেলেটি জীবনের শুরু থেকেই বিচ্ছিন্নতার কী নিদারুণ নিষ্ঠুর শিকার। তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে মাতৃভাষা থেকে, বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ‘চুরি না করার জীবনের মৌলিক নিয়ম’ থেকে। যে মৌলিক নিয়মটি পার্বত্য চট্টগ্রামে এভাবেই কার্যকর যে, সেখানে জন্মগ্রহণকারী যে-কেউ একজন তার সারা জীবনে একটি চুরির ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পারে না। অর্থাৎ তারা জীবনের এই নিয়মটি এভাবেই অনুসরণ করে থাকে যে, তাদের সংস্কৃতিতে চুরির ধারণাটির উন্মেষ ঘটাই একটা অসম্ভব ঘটনা। সুতরাং একজন আদিবাসী জীবনের নিয়ম থেকে চুরির সংজ্ঞা অবগত হতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীটি ও এই শিশুটি দু’টি পৃথক সমাজের বাসিন্দা। এই দু’সমাজের সাংস্কৃতিক ব্যবধান আকাশ পাতাল কিংবা রাত ও দিনের তফাতের মতো। একজন শিশুবয়সেই হাতে কলমে চুরি শিখে নিয়েছে, অন্যজনের কাছে চুরি বিষয়টিই বোধগম্য নয়। সে বুঝেই না চুরি আসলে কী? একজন বাঙালি যখন তারই (ওই আদিবাসীটিরই) বাগান থেকে আনারস চুরি করে নিয়ে চলে যাচ্ছে এবং আদিবাসীটি তার চর্মচোখে তা দেখছে, তখন সে কীছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। বিষয়টা আসলে কী হচ্ছে? তাঁর বিস্ময়বোধক প্রশ্ন, বাঙালি তার বাগান থেকে আনারস নিয়ে যাচ্ছে কেন? তাও আবার রাতের বেলা লুকিয়ে। এটা কী ধরনের বাস্তব ঘটনা? জীবনে সে এমন ঘটনা দেখেনি। সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না এমনটি। আদিবাসীটির এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা কেন?
বেশ ক’বছর আগে এই রকম একটি ঘটনার বর্ণনা করেছিলেন প্রথিত আদিবাসী লেখক সঞ্জীব দ্রং। আমি তাঁর বাংলা লেখার ভক্ত। বিষয়টি নিয়ে তিনি কী বলে ছিলেন তাঁর প্রবন্ধে, তা যথাযথ পুনরোৎপাদন আমার পক্ষে আজ আর সম্ভব নয়। তবে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, ঘটনার বিবরণ থেকে বুঝা গিয়েছিল, আসলে ওই আদিবাসীটির যাপিত জীবনে চুরি বলে কোনও প্রপঞ্চ বা সামাজিক বাস্তবতা নেই। তাই চুরির প্রপঞ্চটি তার মাথায় কীছুতেই ঢুকে না। অর্থাৎ চুরির ঘটনাটি তার মগজে কোনও প্রপঞ্চের চিত্রকল্প তৈরি করছিল না। তা পারবেই বা কেন? না পারারই তো কথা। কারণটাও খুব সহজ, তাঁর সংস্কৃতিতে চুরি প্রপঞ্চের আর্থসামাজিক বাস্তবতা নেই। তাঁর সমাজটা মুক্তবাজার অর্থনীতির বাইরের একটি এলাকা।
মুক্তবাজার অর্থনীতি এমন একটা সমাজবাস্তবতা তৈরি করে, যেখানে মানুষের ব্যবহার্য প্রতিটি বস্তু তৈরি হয় যে শ্রমিক সেÑ বস্তুটি তৈরি করে তার শ্রমের উদ্বৃত্তমূল্যকে চুরি করে। উদ্বৃত্তমূল্যের বিষয়টির অবতারণা বোধ করি একটু জটিল হয়ে যাচ্ছে কারও কারও জন্যে, যেমন আদিবাসীটির কাছে চুরিবিদ্যাটি বুঝার অতীত একটি বিষয় হিসেবে প্রতিভাত হয়। বিষয়টি একটু বুঝার খাতিরে উদ্বৃত্তমূল্য কী একটু বুঝা দরকার আছে। কার্ল মার্কস বলেন, ‘[…] বর্তমান পুঁজির মূল্য অপরের কাছ থেকে দাম-না-দিয়ে আত্মসাৎ করা উদ্বৃত্ত-মূল্যের সর্বমোট পরিমাণ ছাড়া আর কিছু নয়।’
হয় তো সবটা পারবো না। তবু বিষয়টি একটু খোলতাই করার চেষ্টা করি, নিজের সাধ্য মতো। মুক্তবাজার বা পুঁজিবাদী অর্থনীতির অধীনে যে-কোনও প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়ের জন্য উৎপাদন করা হচ্ছে কোনও বস্তু এবং সে-বস্তুটি একটি নির্ধারিত মূল্যে বাজারে বিক্রয় করা হচ্ছে। যে শ্রমিক এই বস্তুটি তৈরি করে পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান বা কারখানার মালিক সে-শ্রমিকের শ্রমশক্তি ক্রয় করে। এই শ্রমশক্তির একটি নির্দিষ্ট অংশের দাম না দিয়েই পুঁজিপতি সেটার মালিক হয়ে যায়। অন্যরকম করে বললে বলতে হয়, শ্রমিকের শ্রমশক্তি পুঁজিপতি আত্মসাৎ করে। যে-টুকু শ্রমশক্তি পুঁজিপতি আত্মসাৎ করে তার বিক্রয়মূল্যটাই উদ্বৃত্তমূল্য। এটাই আত্মসাৎ করে পুঁজিপতি অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়। যার সবটুকুর মালিক প্রকৃতপক্ষে শ্রমিক। শ্রমিকের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া (বলা যায় চুরি করে নেওয়া) শ্রমের মূল্য একত্র হয়েই হয় ধনীলোকের বাড়িগাড়ি, কলকারখানা, বিত্তবৈভব, ব্যাংক ব্যালেন্স যাবতীয় সব কীছু। যে-কোনও ধনীলোকের সমস্ত সম্পদের বৈধ মালিকানা চূড়ান্ত বিচারে কোনও না কোনও শ্রমিক। শ্রমিকের উৎপাদিত বস্তুটির বিক্রয়মূল্যের ভেতরে উদ্বৃত্তমূল্য হিসেবে নিহিতি থাকা মূল্যটাই পুঁজিপতির মুনাফা। অর্থাৎ ‘ক্রয় করে দাম না দেওয়া শ্রম’ শোষণের দ্বারা পুঁজিপতি (উৎপাদনের উপায়ের মালিক) যে মূল্য লাভ করে অর্থাৎ বিনামূল্যে আত্মসাৎ করে তাই উদ্বৃত্তমূল্য।
এই তত্ত্বটির আবিষ্কারক কার্ল মার্কস। তিনি এই তত্ত্বটার দ্বারা দুনিয়ার সকল ধনী লোককে চোর বলে সাব্যস্ত করে গেছেন। ধনীদের কাছে এই জন্য কার্ল মার্কসের চেয়ে বড় শত্রু পৃথিবীতে আর কেউ নেই এবং তাঁর অনুসারীদেরও তারা (ধনীরা) নাপছন্দ করে, বলা যায় একদম দেখতে পারে না এবং পুঁজিবাদী সমাজে মার্কস ও তাঁর ভাবশিষ্যদের বিরুদ্ধে এমন প্রবল প্রচার এখনও পর্যন্ত জায়মান রাখা হয়েছে এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল শাখা একজোট হয়ে এই প্রচারটা অব্যাহত রাখে। আর এই প্রবল প্রচারের ফলপ্রভাবে পুঁজিপতিদের দ্বারা যারা নিদারুণভাবে শোষিত ও নিষ্পেষিত হয়, তারা নিজেদের মিত্র মার্কস ও তাঁর শিষ্যদের প্রতি উল্টো বিতৃষ্ণু হয়ে বসে ছিল, থাকে এবং আছে। মার্কসের এই বিরোধিতার প্রত্যক্ষ সফলতা এই যে, চোর সাধু সেজে দিব্যি কালযাপন করছে, চুরির মাল থেকে দানখয়রাত করে দানবীর উপাধি অর্জন করছে।
তাছাড়া ধনীকের ধর্মপ্রাণতা প্রশ্নাতীত। যদিও ধর্মাদর্শের ঘোষণা অনেকটা এই যে, সূচের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ করা যতোটা কঠিন, ধনীর পক্ষে বেহেস্তে প্রবেশ করা তার চেয়েও কঠিন হবে। সমাজে তাদের মান্যতা কমে না বরং বাড়ে। অপরদিকে গত শতকের নব্বই দশকের আগে একজন প্রলেতারিয়েতের পক্ষের রাজনীতিবিদকে দেশের ধনীদের সঙ্গে গবির লোকেরাও পছন্দ করতো না, সমাজে গণ্যমান্য হবার তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু তিনি যখন নব্বই দশকের পরে বুর্জোয়া রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেন তখন সর্বমহলে তিনি নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
এই ছেলেটি আম চুরি করেছে। তার পক্ষে বোধ করি এটা খুবই স্বাভাবিক। পিছন ফিরে বালকবেলার দিকে তাকালে নিজেকে তো এই ছেলেটির অবিকল সংস্করণ হিসেবেই দেখতে পাই এবং পরিণত বয়সে এসে জানতে পারি, কোরআনে লেখা রয়েছে, ‘পুরুষ ও নারী, এদের যে কেউ চুরি করবে, তাদের হাত দুটো কেটে ফেলো, এটা তাদেরই কর্মফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত দ-, আল্লাহপাক মহাপরাক্রমশালী ও প্রবল প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩৮)। এবং যে-মুহূর্তে আমচোরটি আমার হাতে ধরা পড়েছে সেই মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ চোর পৃথিবীতে চুরি করে ধরা পড়ছে না। বাংলাদেশ তো অবশ্যই তার ব্যতিক্রম নয়। এই ক’দিন আগে পর্যন্ত বাংলাদেশ দুর্নীতিতে, চুরিও একটি দুর্নীতি, ধারাবাহিকভাবে পাঁচ বার বিশ্বসেরার শিরোপা লাভ করেছিল। তখন কেউ কারও হাত কেটে দেয়নি। চুরির অপরাধে বাংলাদেশে হাত কাটার কোনও উদাহরণ বোধ করি নেই। কিন্তু দেশে চুরি তো হচ্ছে। বড় বড় চুরি। হলমার্কের মতো চুরির ঘটনা ঘটছে। কেউ কারও হাত কাটছে না। কিন্তু বিজ্ঞান চর্চাকারীকে হত্যার জন্য হন্যে হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে হর্তাকর্তা-বিধাতারা নামে-বেনামে চোর, এখানে হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপিরা রাষ্ট্রের নাকের ডগায় দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, উপাসনালয়ের সিঁড়ি থেকে জুতো চুরি হয়, চুরির টাকায় লোকে দানবীর উপাধি পায় এবং শত শত উপাসনালয়ের ইট-কাঠ-টিন-সিমেন্ট এমন দানবীরের টাকায় কেনা, ধর্মকে চুরির কাজে ব্যবহার না করে চোর এখন আর চুরি করে আনন্দ পায় না, ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করতে আজকাল সকলেই ভীষণ পটু, লোকে এখন পাশের বাড়ির বাচ্চাটিকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে জিম্মি করে তার বাবার কাছে টাকা চায়, প্রতিবেশীর চারপাঁচ বছরের মেয়েটিকে ধর্ষণ করে রক্তাক্ত করে এবং হত্যা করে। সত্যি মুক্তবাজার অর্থনীতির কী দারুণ কেরদারিশমা।
এইসব চিন্তায় যখন মন বিচ্ছিন্ন তখন অন্য দু’জন একটু সটকে গেলো। সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার ব্যাধি আক্রান্ত ছেলেটিও কখন জানি এক অবসরে চলে। গেলো বুঝতেই পারলাম না।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com