সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ দ্রোহ ও প্রেমের কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯তম জন্মবার্ষিকী। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সারা দেশে দিনটি উদযাপিত হবে নানা আয়োজনে। সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগেও দিবসটি উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে আজ সকাল ৯টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে আলোচনা ও ইসলামিক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম।
‘চির উন্নত মম শির’ বলে কাজী নজরুল ইসলাম সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। গেয়েছেন মানবতার জয়গান।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাবে সেটা ছিল ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। পিতা কাজী ফকির আহমেদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। শৈশব থেকেই অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। লেটো দলের বাদক, রেল গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের শ্রমিক এভাবেই পেরিয়ে গেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। ঘটনাবহুল ছিল তাঁর জীবন। পরে কাজ করেছেন সৈনিক হিসেবে। সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করছেন এইচএমভি ও কলকাতা বেতারে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছেন। পাশাপাশি সাহিত্য সাধনা তো ছিলই। শাসকের কোপানলে পড়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন কিন্তু নত হয়নি নজরুলের উচ্চ শির।
১৯২২ সালে প্রকাশিত কবির বিখ্যাত কাব্য-সংকলন ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে; ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ইত্যাদি। নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল- ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার লেখা অন্যান্য গদ্যের মধ্যে রয়েছে ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প-সংকলন প্রকাশিত হয়; যার নাম ‘ব্যথার দান’। এ ছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন ‘যুগবাণী’ও প্রকাশিত হয়।
নজরুলের সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাঁর গান। ভক্তিমূলক গান, প্রণয়গীতি, প্রকৃতি বন্দনা, দেশাত্মবোধক গান, রাগপ্রধান গান, হাসির গান, ব্যাঙ্গাত্মক গান, সমবেতসঙ্গীত, রণসঙ্গীত এবং বিদেশিসুরাশ্রিত গানসহ ১০টি ভাগে বিভাজ্য হয়েছে কবির গান।
সীমিত কর্মজীবনে তিনি তিন হাজারেও অধিক গান রচনা করেছেন। পৃথিবীর কোনো ভাষায় একক হাতে এত বেশিসংখ্যক গান রচনার উদাহরণ নেই। এসব গানের বড় একটি অংশ তাঁরই সুরারোপিত। তাঁর রচিত ‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। তাঁর কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুলবাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। তবে তিনি প্রায়শ তাৎক্ষণিকভাবে লিখতেন; এ কারণে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে। এ ছাড়া কাজী নজরুল গান রচনাকালে ১৯টি রাগের সৃষ্টি করেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হলো ইসলামি সঙ্গীত তথা গজল। নজরুল প্রায় তিন হাজার গান রচনা এবং সুর করেছেন; যা এখন নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত। মধ্য বয়সে তিনি পিক্স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। এক সময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এ সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে কবির স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে কবিকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়। ওই বছরের ২৯ আগস্ট বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তখনকার পিজি হাসপাতালে) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।