বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে এস্কেভেটরে মাটি কেটে শ্রমিকের নামে মাস্টার রোল করে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা লোপাটের প্রস্তুতি বিষয়ক সংবাদ জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠ ও দৈনিক সুনামকণ্ঠে প্রকাশিত হওয়ায় সরকারের প্রায় ২২ কোটি টাকা রক্ষা হয়েছে। অবশেষে গত ১৭ মে বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট উপজেলা থেকে ফসলরক্ষা বাঁধের চূড়ান্ত বিলের পরিমাণের প্রতিবেদন সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ৯৬৪টি প্রকল্পের মোট ১৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে গঠিত কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটিগুলো ১৫৫ কোটি টাকার কাজ হয়েছে বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এই প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় ১১ উপজেলা কমিটিকে চিঠি দিয়েছিল। এ নিয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠ ও সুনামকণ্ঠে গত ৯ মে ‘৪০ কোটি টাকা লুটের প্রস্তুতি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে জেলায় তোলপাড় শুরু হয়। বরাদ্দ লোপাটের সক্রিয় চক্রও সংবাদের কারণে বিপাকে পড়ে। অবশেষে ফেঁসে যেতে পারে এই আশঙ্কায় চূড়ান্ত পরিমাপ করে শেষ বিল দেওয়ার জন্য পাউবোতে কাগজপত্র প্রেরণ করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের সংশোধিত কাবিটা নীতিমালায় নির্ধারিত দূরত্ব থেকে শ্রমিক ও এস্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটার জন্য সরকার আলাদা রেট নির্ধারণ করে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে প্রায় ১৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। পাউবো ও স্থানীয় কৃষকদের মতে এবং সরেজমিন দেখা গেছে এ বছর প্রায় ৯০ ভাগ বাঁধের কাজে মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে। মেশিনে মাটি কাটার রেট ছিল প্রদি ঘনমিটার ১১৮ টাকা। অন্যদিকে শ্রমিক দিয়ে মাটি কাটানোর রেট ছিল ১৬৮ টাকা। কিন্তু কাজ শেষে মাস্টার রোল জমা দেওয়ার সময় প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি শ্রমিকের নামে বরাদ্দকৃত অতিরিক্ত টাকা আত্মসাৎ করতে শ্রমিকের নামে ভুয়া মাস্টার রোল তৈরির প্রস্তুতি নেয়। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রায় ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে নানা ফন্দিতে সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে গঠিত কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং জেলা কমিটির সদস্যসচিব মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া গত ১ মার্চ কাজের দায়দেনা পরিশোধ বিষয়ে প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা কমিটির সভাপতি বরাবর চূড়ান্ত পরিমাপের প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য লিখিত চিঠি দেন। এফ-২/৯১৭ স্মারকের ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন নীতিমালা অনুযায়ী কোথাও কমপেকশন করা হচ্ছেনা এবং এস্কেভেটর দিয়ে বাঁধের গোড়া থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। প্রাক্কলনে শ্রমিক দিয়ে মাটি কাটার উল্লেখ থাকলেও এস্কেভেটরে মাটি কাটা হচ্ছে বলে তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে সমন্বয়পূর্বক কাজের প্রকৃত দায়দেনা পরিশোধের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে উপজেলা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের আহ্বান জানান তিনি। এই চিঠি পেয়ে আরো বিপাকে পড়ে পিআইসির সংশ্লিষ্টরা।
একই বিষয়ে গত ১৫ এপ্রিল জেলা কমিটির সদস্য সচিব আবারও প্রতিটি উপজেলা সভাপতিকে চিঠি দিয়েছেন। এই চিঠিটি পাওয়ার পরই পিআইসির সংশ্লিষ্টরা ভুয়া মাস্টার রোল তৈরি করে বরাদ্দ লোপাটের বিষয়টি আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এ নিয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠ ও দৈনিক সুনামকণ্ঠে সংবাদ প্রকাশিত হলে জেলায় বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। এর প্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ইতোমধ্যে প্রতিটি উপজেলা থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি চূড়ান্ত বিল পরিমাপ করে প্রতিবেদন জমা দেয়। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পিআইসিগুলো চূড়ান্ত পরিমাপের প্রতিবেদন দাখিল করে। চূড়ান্ত বিল পরিমাপের প্রতিবেদনে দেখা গেছে সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ১৭৭ কোটি টাকার মধ্যে ৯৬৪টি প্রকল্পে সংশ্লিষ্টরা ১৫৫ কোটি টাকার কাজ হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন জমা দেন। এই প্রতিবেদনের ফলে সরকারের প্রায় ২২ কোটি টাকা রক্ষা পেয়েছে বলে মনে করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা। তবে ১৫৫ কোটি টাকার কাজ সম্পাদনের যে চূড়ান্ত বিল দেখানো হয়েছে তাও অতিরিক্ত বলে মনে করেন কৃষকরা। এ নিয়ে আগামী শুক্রবার জেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজে গঠিত কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্যসচিব মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া বলেন, মার্চ মাসে আমি বিলের চূড়ান্ত পরিমাপ করে পাঠানোর জন্য চিঠি লিখেছিলাম। অবশেষে সেই চূড়ান্ত পরিমাপ হাতে পেয়েছি। উপজেলা থেকে প্রদত্ত পরিমাপে সরকারের প্রায় ২২ কোটি টাকা রক্ষা পেয়েছে। তবে উপজেলা কমিটিগুলো কিভাবে ফাইনাল মেজারমেন্ট করেছে সেটা তারাই বলতে পারবে। পত্রিকার রিপোর্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে বলে জানান তিনি।