শামস শামীম ::
‘খাইয়া না খাইয়া ঝি পুত লইয়া খেত খরছিলাম। ২৮, ২৯ ধানো মাইর খাইলিছি, চুছা বেশি। ইবার হকল জমিন খাটাইতাম পারছি ইটাই আমরার খুশি। আমরা এবলা শুকাইল ধান উগারো তুলছি।’
এভাবে হাওরের সম্পূর্ণ ধান কাটতে পেরে খুশি সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের কিষাণী ফুলবানু। দেখার হাওরের গছিলারা কান্দার খলায় ধান শুকানো, বাতাসে চিটা বের করার কাজ করার সময় এভাবেই কথা বলছিলেন তিনি। তার মতো অনেক কিষাণীকে দেখা গেল খলায় ধান শুকানো, বস্তার ভরা, চিটা বের করতে ধান ওড়ানোসহ নানা কাজ করতে। গত ৫ দিনের টানা রোদে কিষাণ-কিষাণীদের ভিড়ে এখন হাওরের ধানখলা মুখর। ধানের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্য খড়ও সংগ্রহ করছেন তারা। কৃষকরা জানিয়েছেন, চাষের তুলনায় এখন জমিতে উৎপাদন মূল্য বাড়ছে। তাছাড়া চিটায় ক্ষতি করেছে তাদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, বজ্রপাত, পাহাড়ি ঢল, বৃষ্টি ও শিলাতঙ্কের মুখে অবশেষে হাওরের সম্পূর্ণ ধান কাটতে সক্ষম হয়েছেন জেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ বোরো চাষী পরিবার। গতকাল বুধবার পর্যন্ত কৃষি বিভাগের মতে সব হাওরের প্রায় শতভাগ বোরো জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বাম্পার ফলনের কথা জানালেও কৃষকরা জানিয়েছেন ধান কাটার শুরুতে অনেক হাওরেই ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ ছিল। যে কারণে বিআর ২৮ ও বিআর ২৯ ধানে এবার চিটার পরিমাণ বেশি। তাছাড়া বীজতলা, ধান রোপণ, ধান কর্তন ও গোলায় তোলতে গিয়ে উৎপাদন মূল্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। সে তুলনায় ধানের বাজারমূল্য এখন অনেক কম। তাছাড়া ন্যায্যমূল্যে সরকারি ধানসংগ্রহের খবরেও খুশি হতে পারেননি কৃষক। এবার হাওর থেকে মাত্র ৬ হাজার মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন পর হাওরের পুরো ফসল কাটতে পেরে উচ্ছ্বসিত হাওরের সংগ্রামী কৃষক। কৃষকদের উচ্ছ্বাসের কথা বিবেচনা করে এবার সুনামগঞ্জের প্রশাসন আড়ম্বর উৎসবের চিন্তা করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, গতকাল ১৬ মে পর্যন্ত জেলার দেড় শতাধিক হাওরে প্রায় শতভাগ বোরো জমি ধান কাটা হয়ে গেছে। অল্প যে জমি রয়েছে তা মূল হাওরের বাইরে উঁচু স্কিম প্রজাতির জমি। জেলায় এ বছর ২ লাখ ২২ হাজার ৭৭৯ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এ থেকে প্রায় ৮ লাখ ৮৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হবে যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ হাজার ২৩৭ কোটি টাকার উপরে। উৎপাদিত চাল জেলার খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে আরো ৫ লাখ মেট্রিক টন উদ্ধৃত্ত থাকার কথা জানিয়েছে জেলা খাদ্য বিভাগ। কৃষি বিভাগ বাম্পার ফলনের কথা ঘোষণা করলেও চিটা ও উৎপাদনমূল্য বেশি হওয়ায় লাভের আশা নেই কৃষকের। নিজের পরিশ্রম বাদে কোনমতে উৎপাদন মূল্য তোলতে পেরেই কৃষকরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
সরেজমিন বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা গেছে হাওরের বোরো ফসল কেটে তুলতে সক্ষম হয়েছেন কৃষক। গত ৩০ এপ্রিল থেকে ১১ মে পর্যন্ত প্রতিদিনই বৃষ্টি, বজ্রপাত হয়েছে হাওরাঞ্চলে। এর মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে একটু রোদের দেখা পেলে কৃষকরা জমিতে ধান কাটার চেষ্টা করেছেন। অনেকে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই ফসলের মায়ায় এর মধ্যেই ফসল কেটে শেষ করেছেন। প্রায় দশদিন ধরে টানা রোদ না থাকায় কেটে আনা ধান শুকাতে না পারায় চারা গজিয়ে অঙ্কুরিত হয়েছে। গত ১২ মে থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত দিনগুলো ছিল রৌদ্রজ্জ্বল। এই সুযোগে হাওরের কৃষক কেটে আনা ধান শুকিয়েছেন ক্লান্তিহীন। কয়দিনে রোদে কেটে আনা প্রায় সব ধান শুকিয়ে গোলায় তোলতে সক্ষম হয়েছেন কৃষক। এখন খড় শুকিয়ে গবাদি পশুর খাদ্য সংগ্রহ করছেন তারা।
কৃষকরা জানিয়েছেন বোরো মওসুমের শুরুতে সরকার হাওরের দেড় লাখ কৃষক পরিবারকে সার, বীজ ও নগদ টাকা দিয়েছিল। গত বছর হাওরের সম্পূর্ণ ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা হাওর থেকে বীজ সংগ্রহ করতে না পারায় সরকার প্রদত্ত বীজেই ধান রোপণ করেন। বিভিন্ন স্থানে এই বীজ দেরিতে চারা গজিয়েছে। ফলে ধানও রোপণ করা হয়েছে বিলম্বে। তাছাড়া বেশ কিছু হাওরের পানিও বিলম্বে নেমেছিল। এদিকে ধান পাকার সময়ে সেই বীজের জমিতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। কৃষকদের বীজ প্রদানের সময় কৃষি বিভাগ এ বিষয়ে প্রচারণা না চালানোয় নতুন এ রোগ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন কৃষক। তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও বিশ্বম্ভরপুরে ব্লাস্ট রোগে কিছু জমি আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করা হলেও অন্যান্য হাওরের বিষয়টি এড়িয়ে যায় কৃষি বিভাগ। তবে এই সময়ে তাদেরকে বহুজাতিক কোম্পানির কীটনাশক ছিটানোর জন্য কৃষকদের বুঝাতে দেখা গেছে। কৃষকরা বলছেন, টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় ব্লাস্ট রোগ কমে আসে। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ব্লাস্ট হয়েছিল। তবে এই ব্লাস্টের কারণে কমবেশি প্রতিটি হাওরেই জমি আক্রান্ত হয়েছে। এসময় টানা বৃষ্টির কারণে আক্রান্তের পরিমাণ কম থাকলেও কৃষকরা জানান, ২৮ ও ২৯ ধানে চিটার পরিমাণ বেশি। তাছাড়া টানা কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে ধান ভিজে গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মূল্যও কমে গেছে অনেকগুণ।
দিরাই উপজেলার শ্যামারচর এলাকার কৃষক নেতা অমর চাঁদ দাস বলেন, আমাদের হাওরগুলোর সব ধান গত ৮-১০ বছর বাদে কাটতে সক্ষম হয়েছে কৃষক। গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে ধান শুকাতে না পারলেও কয়েকদিনের প্রখর রোদে সব ধান শুকিয়ে গোলায় তুলেছেন, একই সঙ্গে খড়ও শুকিয়ে সংরক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, লাভ-ক্ষতির হিসাব পরে, ধান কেটে তুলতে পারছে এটাই কৃষকের কাছে এখন বড় ঘটনা। কারণ গত কয়েক বছর তারা পুরো ফসল গোলায় তোলা থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে ধানের মূল্য অনেক কম বলে তিনি জানান।
দেখার হাওরের বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক সৈয়দুর মিয়া বলেন, এবার বিআর ২৮ ও বিআর ২৯ ধানে চিটার পরিমাণ বেশি, তবে ফলন ভালোও বলা যাবেনা, মন্দওনা, মাঝামাঝি ফলন হয়েছে। তিনি জানান, এক কেয়ার (৩০ শতাংশ) জমি চাষ করতে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৮ হাজার টাকা। এই জমিতে ধান পেয়েছেন ১২-১৪ মন। বর্তমানে এই পরিমাণ ধানের দাম ৭ হাজার টাকা।
হালুয়ারগাঁও গ্রামের কৃষক ইছব আলী বলেন, ‘ইবার চুছার লাগি বেশি ফলন অইছেনা। হকল ধান খাটতাম পারছি ইটাই আমরার লাগি বড় কথা। তিনি জানান, ধান বীজতলা তৈরি, ধান রোপণ, কাটা এবং গোলায় তোলতে পরিবহন খরচ অত্যধিক হয়ে গেছে। নিজের শ্রমমূল্য বাদ দিয়েও উৎপাদন খরচ উঠছেনা। তাছাড়া সরকার ধানের মূল্য যে ১ হাজার ৪০ টাকা নির্ধারণ করছে সে বিষয়ে ধারণা নেই তার। কখনো সরকারিভাবে ধান দেওয়ার সুযোগও পাননি তিনি।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, সব বছরই মার খায় কৃষক। এবার চিটায় বেশ ক্ষতি হলেও পুরো ফসল কাটতে পেরে খুশি কৃষক। তিনি বলেন, মওসুমের শুরুতে বীজ প্রদানের সময় কৃষি বিভাগ ব্লাস্ট রোগের বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করলে রোগ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে পারতেন কৃষক। এতে বাম্পার ফলন হতো।
তাহিরপুরের শনির হাওরের কৃষক গোলাম সরোয়ার বলেন, হাওরের কৃষকরা রাতদিন কাজ করেও শ্রমমূল্য পাচ্ছেনা। এরপরও প্রতি বছরই ফসলের ক্ষতি হয়। এবার বন্যার মুখোমুখি না হওয়ায় মোটামুটি হাওরের পুরো ধান কাটতে সক্ষম হয়েছেন কৃষক। কৃষকরা হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেও শ্রমমূল্য পাচ্ছেন না। বাজারে ধানের দাম অনেক কম। সরকারি ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত কৃষক।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক স্বপন কুমার সাহা বলেন, প্রায় শতভাগ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। ব্লাস্টে তেমন ক্ষতি হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। সব ফসল কেটে এখন গোলায়ও তুলে ফেলেছেন কৃষক। তাই আমরা ফসল তোলার উৎসব করার চিন্তা করছি।