দেশ-বিদেশের মানুষ জানে ১৯৭১-য়ের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষকে পাক হানাদাররা হত্যা করেছিল। সেই সঙ্গে ৪ লক্ষাধিক নারী নির্যাতিত হয়েছিলেন। তাছাড়া লুটপাট, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি এমন কোনও জঘন্য কাজ নেই যা তারা করেনি। মানবতাবিরোধী এইসব অপকর্মে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে ছিল দেশীয় কীছু লোকজন। তাদের নিয়ে তখন পাকস্তানিরা সারাদেশের এলাকায় এলাকায় শান্তি কমিটি করেছিল। আর তৈরি করেছিল বেশ কয়েকটি বাহিনী। যেমন রাজাকার, আল বদর, আল শামস ইত্যাদি বাহিনী। দেশীয় এই বাহিনীর কাজই ছিল অনুসন্ধান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদেরকে বিশেষ করে যুবকদেরকে ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে হত্যা করার জন্য আর নারীদেরকে ধর্ষণের জন্য তোলে দেওয়া। এর বাইরে তাদের আরও ক’টি কাজ ছিল, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা। সারাদেশের মতো সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লার প্রত্যন্ত এলাকা উজানগাঁও, দৌলতপুর, পেরুয়া, ভল্লবপুর প্রভৃতি গ্রামে গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু বিচার হবে দূরে থাক, এইসব হত্যা-নির্যাতনের কাহিনী স্বাধীনোত্তরকালেও এতোদিন চাপা পড়েছিল, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের সামাজিক-রাজনীতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রবল থাবার নিচে। সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়েছে, “৭৫ পরবর্তী পটপরিবর্তনে এলাকায় ফিরে এসে ত্রাসে পরিণত হয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। বর্তমানে প্রভাব, প্রতিপত্তি, অর্থবিত্ত ও রাজনীতিতে শীর্ষে থাকায় তারাই এই এলাকা শাসন করছে। ফলে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন এখনো এই এলাকায় কোণঠাসা।” সে যা’-ই হোক। দিনে দিনে দিন বদলে গেছে। সুদীর্ঘ সাড়ে চার দশকেরও পরে সুদিন এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত বিচার না-পাওয়া অবহেলিত মানুষজনের জীবনে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
উজানগাঁও, দৌলতপুর, পেরুয়া, ভল্লবপুর প্রভৃতি গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট নিয়ে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। প্রাথমিক খসড়া তদন্ত ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে গত ২২ এপ্রিল ২০১৮ রোববার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও কর্মকর্তারা তদন্ত করে গেছেন। এই তদন্ত কার্যক্রম জেলার সাধারণ মানুষজনকে ভীষণ উদ্দীপ্ত করেছে। লোকে মনে করতো এ দেশ এমন একটি দেশ যেখানে গণহত্যা ও গণধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের বিচার করা সম্ভব নয়। তদুপরি অপরাধীরা সামাজিক-রাজনীতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল তাদের উপর অত্যাচারের চাবুক চালিয়েই কালাতিপাত করবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কার্যক্রম মানুষের মনে বদ্ধমূল সে ধারণা ভেঙে দিয়েছে। ট্রাইব্যুনালকে অভিনন্দন, অভিনন্দন মুক্তিযুদ্ধবান্ধব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে।
এই যুদ্ধাপরাধ মামলার বাদীরা অর্থবল, জনবল, লাঠির বল কোনও বলেই বলীয়ান নয়। তাদের বল একমাত্র সরকার আর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বাদীরা প্রতি মুহূর্তে বিবাদীদের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে হুমকির সম্মুখীন হবে। এমনকি তারা প্রাণনাশে হুমকিরও সম্মুখীন হতে পারে। আশা করি বিচার চলাকালে সরকার তাদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করবেন।
পরিশেষে বলি, এই বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে-দেশে কোনও অপরাধীই পার পায় না। এখানে অপরাধী শেষ পর্যন্ত উচিত দণ্ডাধিকারী হয়। যথাযথ বিচারের মাধ্যমে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না করে বাংলাদেশ থামে না।