মো. আমিনুল ইসলাম ::
যুগের আধুনিকতার সাথে গণমাধ্যমগুলো উন্নত পরিসরে আমাদের সামনে আবির্ভূত হলেও মানুষকে বোকা বানানোর খেলায় মত্ত একদল ‘সাংবাদিক’ নামধারী। এরা টাকা ছাড়া কলম চালাতে রাজি নন। তাদের মেধা ও যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। অন্যের লেখা প্রতিবেদন কপি করে তার কিছুটা এদিক-সেদিক করেই দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন কাজ-কারবার। অনেকে আবার অন্যের লেখা হুবহু পাঠিয়েই দীর্ঘদিন ধরে ‘সাংবাদিক’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে চলছেন। সাধারণ মানুষের সাথে ধান্দাবাজি তো তাদের নিয়মিত বিষয়। বিভিন্ন দপ্তরেও রয়েছে তাদের দাপট। এমন অবস্থায় ‘সাংবাদিক’ শব্দটা যেন অনেক মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ‘হলুদের’ ভিড়ে আরো ‘নীল’ ঘাপটি মেরে আছে, এই হলুদ আর নীলদের ছায়াতলে আরও আছে ‘মাল্টিকালার’। যারা ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। তবে একথাও অস্বীকার করা যায় না অনেক গণমাধ্যমকর্মীও রয়েছেন, যাঁরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেদের আদর্শকে বিকিয়ে দিচ্ছেন না। প্রকৃত গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ আছেন যারা কখনোই ‘হলুদ ও নীলদের’ প্রশ্রয় দেন না।
২০০৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সুনামগঞ্জের গণমাধ্যম জগতে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি। পথচলার এতোটা বছরে অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ঋদ্ধ হয়েছি বিচিত্র অভিজ্ঞতায়। সাধারণ মানুষের কাছে সাংবাদিকতা এখন ভিন্ন ভিন্ন ধারণার।
এইতো গত মাসে শহরের একজন আমাকে তাঁর পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দেখিয়ে বললেনÑ ‘আমিও এখন সাংবাদিক, আপনারা তো খালি জেলার ভেতরেই কাজ করেন, আমি সারা বাংলাদেশের স্টাফ রিপোর্টার। ঢাকা থেকে এই কার্ডটা আমি করিয়ে আনলাম। দেখেন না কার্ডটা হাতে নিয়ে।’
তাঁর কথা শুনে প্রথমে একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। যতোটা জানি তিনি একটা সংগঠন চালান। নামটা নাই বললাম। কার্ডের উপরের অংশে যে পত্রিকাটার লোগো শোভা পাচ্ছিলো এ নামে আমি আজ পর্যন্ত কোন পত্রিকা বাজারে দেখিনি। পত্রিকার নামটাই আমি প্রথমবারের মতো শুনেছিলাম।
কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে আমার এক বন্ধু সুনামগঞ্জ বেড়াতে এসেছিল। রাতের শহরের ফাঁকা সড়ক ধরে হাঁটছিলাম আমরা। সে এক সময় সুনামগঞ্জেই থাকতো। খেলা আর আড্ডাবাজিতেই আমাদের দিনগুলি কেটেছে। স্কুল-কলেজ জীবনের আমরা ছিলাম মাণিকজোড়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুবাদে সে এখন ঢাকার বাসিন্দা। তার নাম রুম্মান আল আসাদ। সে সাংবাদিককে ‘সাংঘাতিক’ বলেই ডাকতে পছন্দ করে। কেন তার এমন ধারণা সেটা জানতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে কখনোই আমার সাথে অতোটা সময় নিয়ে কথা বলতে পারতো না। ব্যস্ততা হয়তো তার আমার চেয়ে একটু বেশিই। পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম চাকরি করে সে। যাই হোক, রাতের সুনামগঞ্জ শহর আমার কাছে সবসময়ই অসাধারণ লাগে। রাত ২টায় অফিসের কাজ শেষ করে বের হলাম রুম্মানকে নিয়ে। আকাশে চাঁদ; তার সৌন্দর্য্যে আমরা মুগ্ধ। যেন আকাশ ভেঙে জোছনা পড়ছে সুনামগঞ্জ শহরে। রুম্মান পুরনো অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারলো না। দেখা হলেই ‘সাংঘাতিক’ বলে ডাক দেয়। এবারো তাই করলো।
শহরের আলফাত স্কয়ারে চায়ের দোকান থেকে দুই কাপ চা নিলাম। চা না হলে আড্ডাবাজি তো আর জমে না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই রুম্মান বলতে লাগলÑ ‘তোর সাংবাদিকতার খবর কী? তোরা তো আবার যা খুশি করতে পারিস! এতো রাতে রাস্তায় চললেও তোদের নো সমস্যা। কিছু হলেই তোরা পকেট থেকে কার্ড বের করে দেখাতে পারিস যে- তোরা সাংঘাতিক!’ এক শ্বাসেই সে কথাগুলো বলতে লাগল।
তার কথা শুনে একটু হাস্যরসে উত্তর দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আর হলো না, কারণ চায়ের দোকানে পুলিশ এসেছে। তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করতে হবে। তাই চায়ের কাপগুলো দোকানির ফেরত চাই। রঙ চায়ের পেয়ালাতে দু’তিন চুমুক দিয়ে বাকিটা ফেলে দিতে হল।
পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে দেখে বললেনÑ ‘কী ভাই? আজ দেখি তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন। অফিসের কাজ শেষ না-কি?’। আমি বললাম, ‘আমার এক বন্ধুর সাথে আজ আড্ডা দিতেই বেরিয়েছি। বদলে যাওয়া এই শহরটাকে বন্ধুর সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেব। তাই একটু ঘোরাঘুরি…।’
ওই পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কুশল বিনিময় শেষ করে চায়ের দোকানে টাকা দিতে গেলাম। কিন্তু বিল টা কেউ আগেই দিয়ে দিয়েছে। জানতে চাইলাম বিষয়টা কী। এমন সময় পিঠে একটা ঘুষি দিয়ে বন্ধু রুম্মান বললোÑ টাকা আর দিতে হবে না, আমি থাকতে ‘সাংঘাতিক’ সাহেব টাকা খরচ করবেন! এইটা হতে দেয়া যায় না। চল রিভারভিউ গিয়ে তোর গান শুনি।’
আমরা দু’জন পা বাড়ালাম উকিলপাড়া এলাকার রিভারভিউয়ের উদ্দেশ্যে। পথ চলতে চলতে রুম্মান বললো, ‘বন্ধু তুই কি রাগ করেছিস?’ আমি বললাম- ‘কেন?’
সে বললো বন্ধু আমি তোকে ‘সাংঘাতিক’ বলে ডাকি মজা করে। যদিও তুই ওদের মতো ‘সাংঘাতিক’ না, তবুও এই প্রফেশনটা তুই ছেড়ে দিলেই পারিস, কারণ সাংবাদিকদেরকে এখন মানুষ ভালো চোখে দেখেনা। কিছু লোক নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের ‘গলা কাটায়’ ব্যস্ত। এরা কসাই প্রকৃতির। আর বেতনই বা কতো পাচ্ছিস। ওদের মতো ‘ধান্দা’ করতে পারলে তো ভালোই হতো। বলতে গেলে যাদের কিছু ছিলনা তাদের অনেকে সাংবাদিকতায় এসে দালান তোলেছে। দুই-তিনটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও খুলেছে। আহা… সাংবাদিকতা যেন আলাদিনের চেরাগ। তুই কেন এখনো পিছিয়ে আছিস? তোর পরিচিতিও তো আছে, কিছু একটা কর।’
তাঁর কথাগুলো শুনে এবার একটু হাসলাম। সোডিয়ামের আলোয় ফাঁকা রাস্তাটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আমি তাঁকে উত্তরে বেশি কিছু বলতে পারলাম না। কারণ তাঁর কথাগুলোর অনেকটাই এখনকার সময়ের চরম বাস্তবতা। মানুষ এখন যেন ঘোর স্বার্থবাদী। তাঁকে এতটুকুই বললাম ‘ভাই আমি আমার মতো, আর বাকিরা বাকিদের মতোই। সৃষ্টিকর্তা যখন সবকিছু দেখছেন তিনিই সবকিছুর ফয়সালাকারি। আমি শখ থেকেই সংবাদ জগতে এসেছিলাম। এখন এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছি। আমার কলম মানুষের জন্য, মানুষকে মারার জন্য নয়। ধান্দাবাজদের সবাই চেনে। সময়ে সময়ে তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়। দরিদ্রতার বেষ্টনিতেই আমি অনেক ভালো আছি। আর মোটরসাইকেলের কথা বলছিস না? আমার বাবা শ্রমিক ছিলেন। তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা উপার্জন করতেন তা দিয়েই আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন। মা-বাবা’র সততা আর চোখের জল দেখে বড় হয়েছি। আমরা অভাবের সঙ্গেই সংগ্রাম করতে অভ্যস্ত। মা-বাবা’র কাছ থেকেই প্রথম পাঠ নিয়েছি। তাঁরাই আদর্শ ও সততার পথ দেখিয়েছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্যারদের কথা এখনো ভুলে যাইনি। বাস্তবতা থেকে এখনো শিখছি। অল্প অল্প করে জমানো টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনছি, ওদের মতো লোকদেখিয়ে কি লাভ বল? আমি তো আর সাহেবের ছেলে নই। ধান্দা করে চললে হয়তো পকেটে টাকা ঢুকবে, সামনে পেলে বয়স কম হলেও লোকে সালাম ঠুকবে, আর পেছনে ‘শালা’ বলে গালি দিবে, সঙ্গে মা-বাপকে ছেড়ে কথা বলবে না। তাই ওদের মতো বড় হওয়ার চেয়ে ছোট থাকা অনেক ভালো। শহরের সবাই তাদের চেনে। তাদের মুখে মধু, অন্তরে বিষ। নিজের স্বার্থ হাসিলে তারা সবসময়ই মরিয়া। যাকে পায় তাকে ব্যবহার করে। কেউ তাদের হাত থেকে বাদ যায় না।
রুম্মান বললোÑ ‘তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। তবে তোদের মিডিয়াপাড়ায় অনেক সাংবাদিকের নাম শুনেছি যারা নাকি দাপট খাটিয়েই চলে। তাদের পরিচিতিও ব্যাপক। গণমাধ্যমের নাম ভাঙিয়ে ওরা তো বেশ ভালোই চলছে। সাথে অনেকেরই ভালো ব্যবসা আছে, অনেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বিভিন্নজনের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করার চেষ্টায় থাকে। সংবাদ লেখা ছেড়ে তারা বিভিন্ন দপ্তরে তদবিরে ব্যস্ত থাকে। সাথে চলে অন্যান্য ধান্দা। এসব সাংঘাতিকদের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে সুবিধার দুয়ার খোলা থাকে। আর তুই কি-না বসে আছিস?’
আমরা তখন উকিলপাড়া পয়েন্টে পৌঁছেছি। বায়ে মোড় নিয়ে রিভারভিউ’র দিকে হাঁটছি। পুরনো বন্ধুটাকে পেয়ে আর তাঁর মুখে চরম বাস্তব কিছু কথা শুনে মন্দ লাগছে না। কারণ সত্য এবং বাস্তবতার মুখোমুখি হতে আমি সব সময়ই পছন্দ করি।
মৃদু বাতাস গায়ে এসে লাগছে। হিমেল হাওয়া আর সুরমার বুকে জল-জোছনার নাচন বারবার আন্দোলিত করছে মনকে। আমি যেন রুম্মানের কথার উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবু বললামÑ ‘তুই তো দেখি সাংবাদিকদের নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিয়েছিস। কই নিজের কথা বলবি, এতোদিন পর দেখা। কিন্তু তুই সাংবাদিকদের পেছনে লাগলি কেন? আমি প্রসঙ্গ বারবার অন্যদিকে মোড় দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। বললাম- ‘এসব কথা আপাতত থাক। আমি ছোট মানুষ ভাই, এতোকিছু বুঝার দরকার নাই। আমার অতো সুবিধার কি দরকার আছে? যা আছে তাই নিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। দিন দিন নিজের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হচ্ছে, তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকি।’
রুম্মান বলে উঠলোÑ ‘হলুদে মাখামাখি সাংবাদিকরা যখন অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে সেখানে তুই একা ভালোগিরি দেখিয়ে কতোদিন টিকবি? তোদের সাংবাদিক জগতে তো অভিনেতাদের অভাব নেই। দেখবি তোকে দেখলে বলবে আমিনুল এর মতো ভালো ছেলে হতেই পারে না, আর পেছনে তোকে বিপদে ফেলার কোন চান্স পেলে সবার আগে সেই চান্সটাই কাজে লাগাবে। কারণ কি জানিস? কারণটা হচ্ছে তুই তাদের স্বরূপ সম্পর্কে জানিস।’
আমি আমার কথাগুলো এমনিতেই গুছিয়ে বলতে পারি না। ইনিয়ে-বিনিয়ে তেলবাজি করতে পারিনা। বন্ধু রুম্মানকে ‘সাংবাদিকতা’ প্রসঙ্গ থেকে সরাতেই পারছিলাম না।
গভীর রাতে জনশূন্য রিভারভিউ। আমরা বসে আছি একটি বেঞ্চে। তাকে বললাম ‘একটা গান চালা তো ভাই, তোর ফোনে ভালো গান থাকার কথা। সে উত্তরে বললো ‘আজ বাজাবো না, আজ গাইবো। তবে তার আগে কথাগুলো শেষ করে নিই। তুই তো সাংবাদিকদের কোন দলে ছিলি না -এখন কি কোন দলে ঢুকেছিস? তোদের এখানো তো দুটি প্রেসক্লাব ছিল, দলাদলি ছিল, এখন কি আরো একটি হয়েছে নাকি?’
উত্তরে আমার কথা খুব সংক্ষিপ্তÑ ‘ভাই আমি কারো দলে ঢুকে লাভ নেই। আমার অভিজ্ঞতা খুব অল্প, যা একটু লেখালেখির অভ্যাস গড়ে উঠেছে তাই নিয়ে ভালো আছি। কারো দলে ঢুকলে অন্য দলের লোকদের কাছে খারাপ হয়ে যাবো, এমনিতেই নিন্দুকের অভাব নেই। আমি কাজ করতে গেলে তাদের যেনো বড়সরো কোন ক্ষতি হয়ে যায়, আমি কারো কাছ থেকে নিউজ চেয়ে আনি না, আজ পর্যন্ত যতোটা সংবাদ লিখেছি তা নিজের কলমে। গণমাধ্যম জগতে এখন পর্যন্ত যারা আছেন তারা সবাই আমার সিনিয়র। আমি জুনিয়র, আর জুনিয়রই থাকতে চাই, তবে সুনামগঞ্জের সকল রিপোর্টাররা মিলে আমরা রিপোর্টার্স ইউনিটি করেছি। মূলধারার সকল সংবাদকর্মী যারা সব সময় মাঠেই সংবাদ সংগ্রহ করার দৌড়ে থাকেন তারা সবাই রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সদস্য হয়েছেন, আমিও তাদের একজন’।
বন্ধু রুম্মান আমার কথায় রেগেই গেলো প্রায়। সে বলে উঠলো ‘এর জন্যই তরে আমি গাধা বলি। জীবনে কেবল ঠকা খেয়েই গেলি। নিজেরে এতোটা ছোট করে ভাবিস কেন? এই অভ্যাসটা ছাড়, আমার জানামতে সুনামগঞ্জে এমনও সাংবাদিক আছে যাদের আগে কিছুই ছিলো না, এখন তাদের থাই কাঁচের জানালা আর নকশায় আবৃত বাড়ি দেখলে নিজেকেই শহরের সবচেয়ে গরিব মনে হয়। এরা তো সরাসরি চাঁদাবাজ বলেও খ্যাত। ‘টাকা’ শুনলেই দল বেঁধে গাড়ি নিয়ে ছুটে। গাড়ি আর মোটরসাইকেল যাই বলিস তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ওরা আবার নাকি সমাজের বিবেক। এজন্যই বলেছি তুই ওদের মতো হতেও পারবি না, আর জীবনে কিছু করতেও পারবি না, ছেড়ে দে এ কাজ, আমি তোকে ঢাকায় ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেব।’
রুম্মানের কথা শুনে এখন আর কিছু বললাম না। পকেট থেকে মুঠোফোনটা বের করে একটা গান চালিয়ে দিলাম। সে আমার মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। আমি তার দিকে একটু ফিরে তাকাতেই সে একটা হাসি দিয়ে বললো ‘রাগ করেছিস..? আমি জানি তুই সেই আগের মতোই আছিস। কারো কথায় নাক গলাতে রাজি না। বন্ধু, দুনিয়াটা যে এতো সহজ নয়। আজ তোর এ সামান্য উপার্জনে দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে, কাল কি করবি? ওরা ধান্দার সাথে ধাপ্পাবাজিও চালায়, দুই হাজার টাকা পেলে বলবে প্রতিষ্ঠান তাদেরকে ২০ হাজার টাকা দেয়। আমার জানামতে তো হাতে গোনা কয়টা মিডিয়া ছাড়া কোনটাই তাদের প্রতিনিধিকে মাসিক সেলারি তেমন দেয় না। তাইলে এই ‘সাংঘাতিকরা’ চলে কেমনে? তাদের অর্থের উৎস কোথায়? কিন্তু তাদের চলাফেরা তো তোর আমার চেয়ে অনেক ভালো। সাধারণ মানুষের কাছে যা অবাক লাগারই কথা, এজন্যই সাধারণ মানুষ মনে করে সাংবাদিকতায় টাকার অভাব নেই, আর নতুন যারা আসছে তাদের কয়েকজন যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তাতে মনে হয়…।
আমি ‘মিটি মিটি’ হাসছি। রুম্মানের মতো মেধাবী ছেলেকে বুঝিয়ে বলার কিছু নাই। সে তো খুব একটা মিথ্যে বলেনি। সে তো অনেক ‘অপ্রিয়’ বাস্তবতার কথা বলছে। তাঁর প্রশ্নগুলোর অনেক উত্তর অজানা।
আমি বললামÑ ভাই আমি নিজেকে নিয়ে থাকতে পছন্দ করি। আমার ব্যাপারে তুই যদি কোনো অভিযোগ শুনে থাকিস তাহলে সেটা বল। এতো কথা বলে কী লাভ। যে যেমন কর্ম করবে, সে অনুযায়ী ফল পাবে। যাদের জন্য সংবাদ জগৎ কলঙ্কিত হচ্ছে কেবল তাদেরকেই লোকে খারাপ বলবে। এজন্য এটা নয় যে সবাইকে লোকে খারাপ বলবে। এখনো সুনামগঞ্জে অনেক ভালোমানের এবং যোগ্যতাসম্পন্ন গণমাধ্যম কর্মী আছেন যাঁদের জন্য আমরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে থেকে কাজ করতে পারছি। অনেক সিনিয়র আছেন যাদের জন্য মাথা উঁচু করেই চলি। গুটি কয়েকের জন্য সবাইকে খারাপ বলা ঠিক না। আমি টাকার জন্য কাজ করি না। দীর্ঘ ৬ বছর বিনাবেতনে সাপ্তাহিক সুনামকণ্ঠে কাজ করেছি। তবুও তো আমি এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেইনি। আজ পর্যন্ত এই পত্রিকাটির সাথেই আছি, কেন জানিস? শিখবো বলে, প্রতিনিয়তই শিখছি। আমি শখ থেকেই সাংবাদিকতায় এসেছিলাম আর আমার সংবাদ জীবনের সবটুকুই এ পত্রিকার অবদান। আগামী ৫ বছর যদি আমার সেলারি নাও থাকে তাহলেও কোন ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। আমি বিশ্বাস করি, সুনামকণ্ঠকে যেভাবে আমি ভালবাসি, সুনামকণ্ঠও আমাকে তেমনি ভালবাসে।
রুম্মানকে বললাম- এমনিতেই কম কথা বলি। এখন তোর সাথে বকবক করতে হচ্ছে। তোর সাথে কথা বললে রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে যাবে। তুই যেভাবে সোজাসাপ্টা কথাগুলো বলেছিস তাতে আমার খারাপ লাগেনি। ক’জনই পারে সত্যি কথা সহজ করে বলতে?
আমার কথায় রুম্মান কেবল মাথা ঝাকায়। সে আর কথা বলতে আগের মতো আগ্রহী না। আমি তাকে আরো কিছু কথা বললাম। আমি বললাম, ‘সাংবাদিকতায় দায়িত্ব নিয়ে যারা কাজ করে তারা কখনো নিজের চিন্তা করার সুযোগ পায় না। একটার পর একটা কাজ আছেই, আমি আমার দায়িত্ববোধের উপর শ্রদ্ধাশীল। পত্রিকা আমাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন কেন দেবে? তারাও তো আমার কাছে কিছু ভালো প্রতিবেদন আশা করে। এ বয়সে দৌড়ঝাঁপ না করলে কবে করবো? ভালোবাসা-ভালোলাগার এই শহরকে আমি খুব আপন করে ভাবি। এই শহরের সবাই আমার আপনজন। তাঁদের ভালবাসা-প্রেরণা আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। যতদিন সাংবাদিকতা পেশায় আছি ততো সৎভাবেই দায়িত্ব পালন করে যাব। ‘ধান্দাবাজ’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘চাটুকার’ না হয়ে সৎভাবে বাঁচতে চাই। আমার মতো গরিবের জন্য দুই বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাতই যথেষ্ট।
বন্ধু রুম্মান এবার কিছুটা শান্ত হল। সাংবাদিকদের নিয়ে তত্ত্বকথা থামালো। পকেট থেকে সেলফোন বের করে গান বাজাতে শুরু করলো। রাধারমণ, আবদুল করিম, হাছনরাজা’র গান। আধুনিক গানও বাদ দিলো না। উদাস করা বাউল সুর ভোররাতের আড্ডাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলল। রাত শেষের পথে। চাঁদকে বিদায় জানাতে সূর্য মামা পূর্বদিকে উঁকি দিচ্ছেন। ভোরের হাওয়া, পাখির কুজন… সে এক অন্যরকম অনুভূতি। এবার আমাদের নীড়ে ফেরার পালা। দুই বন্ধু রিভারভিউ থেকে হেঁটে চললাম।
ওইদিন প্রিয় বন্ধুর সাথে আলাপ-চারিতায় সাংবাদিকতার অনেক কিছুই উঠে এসেছিল। যাই হোক গণতান্ত্রিক দেশে জনগণ সবচেয়ে ক্ষমতাবান। তাঁরাই সবকিছু বিচার করবেন। মানুষ আর এখন এতোটা বোকা না, তাঁরা সবই দেখছেন, সবই বুঝেন, সবই জানেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা। সময়ই সবকিছুর জবাব দেবে।
সুনামকণ্ঠ লাখো পাঠকের ভালবাসায় যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক -এই কামনা করি। জনগণের নির্ভরতা আর আস্থার প্রতীক দৈনিক সুনামকণ্ঠ’র ৪র্থ বর্ষে পদার্পণলগ্নে সবাইকে শুভেচ্ছা। সেই সাথে সুনামকণ্ঠ’র সম্পাদকম-লীর সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. জিয়াউল হক, সম্পাদক বিজন সেন রায়, প্রধান বার্তা সম্পাদক শামস শামীম, প্ল্যানিং এডিটর মাহমুদুর রহমান তারেক, সাব-এডিটর বিশ্বজিৎ সেন পাপন, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার রেজাউল করিম, স্টাফ রিপোর্টার মোসাইদ রাহাত, গ্রাফিক ইনচার্জ মিল্লাত আহমেদসহ অন্যান্য বিভাগের সংবাদকর্মীদের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি। আমি সুনামকণ্ঠ’র সকল উপজেলা প্রতিনিধি, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, এজেন্ট, হকার ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই সুনামকণ্ঠ প্রতিদিন পাঠকের হাতে পৌঁছায়। টানা ১৪ বছর সাপ্তাহিক প্রকাশনার পর ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকা হিসেবে ৪র্থ বর্ষে পা রাখলো সুনামকণ্ঠ। সময়ে অনন্য সাহসিকতার প্রমাণ রেখে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাঠকের সামনে তোলে ধরতে আমরা কখনোই ভয় পাইনি। সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন সুনামকণ্ঠ সামনের দিনগুলোতে আরো সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। পাঠকের ভালোবাসা আর নির্ভরতার জায়গা সুনামকণ্ঠ। পরিশেষে এ কথাটাই বলবো- সুনামকণ্ঠ চিরজীবী হোক। জয় হোক বিবেকের। জয় হোক মানবতার।
[মো. আমিনুল ইসলাম, চিফ রিপোর্টার (অপরাধ বিষয়ক বিভাগ), দৈনিক সুনামকণ্ঠ]