দীপন নন্দী::
সময় প্রবহমান। সময়ের সঙ্গে সম্পর্কের উঠা-নামাকে সহজেই সাগরের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তুলনা করা যায়। কিছু সম্পর্ক থাকে দীর্ঘদিনের। ঘড়ির কাঁটার মতো; কখনও একে আসে, কখনও আবার বারোতে। মাঝে দুই থেকে এগারো… সম্পর্কের টানাপোড়েনের কাজ করে। এর মধ্যে কখনও আনন্দ আসে, কখনও বিষাদের নীল ছায়ায় আবদ্ধ হয়। এত শত সম্পর্কের মাঝে কিছু সম্পর্ক সময়কে আটকে দেয়। বলা যেতে পারে ছেলেবেলায় খেলা ’স্ট্যাচু’র মতো। থমকে দাঁড়ানো এমন এক সম্পর্কে আমাকে আটকে দিয়েছে সুনামগঞ্জের পাঠকপ্রিয় “দৈনিক সুনামকণ্ঠ”। তিন কি সাড়ে তিন দিনের ছোট্ট সফরেই এই পত্রিকাটির সঙ্গে আমার সম্পর্ককে গাঢ় করেছে। সময় যতই এগুচ্ছে ততই তা দৃঢ় হচ্ছে। আর সম্পর্কের মাঝে সেতুবন্ধনের কাজটি করছেন দীর্ঘদেহী প্রতিবেদক মো. আমিনুল ইসলাম। সদাহাস্যোজ্জ্বল এই ছেলেটি পেশাগত সম্পর্কের বাইরেও বন্ধুত্বের এক বন্ধনে যেমন নিজেকে বেঁধেছেন, তেমনি করে তাঁর প্রতিষ্ঠান সুনামকণ্ঠকেও আবদ্ধ করেছেন।
খুব ছোটবেলায় কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আমার আগমন। কখনও কোন জেলা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হওয়া হয়নি আমার। সব সময় ছোট-বড় বিট নিয়ে কাজ করে চলেছি। দীর্ঘদিন ধরেই ইচ্ছা ছিল সুনামগঞ্জ যাওয়ার। উদ্দেশ্য হাওরবাসীর জীবনযাপন নিয়ে কিছু প্রতিবেদন করা। আরও শখ ছিল হাওরের মাঝে নৌকায় চড়ে বৃষ্টি দেখা। এসব মাথায় নিয়ে ছোট্ট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড় দিলাম এক বর্ষায়। তখন কর্মক্ষেত্র দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলামেইল। আগেই মুঠোফোনে আমিনুলের সঙ্গে সংযোগ। মোটরসাইকেল সে হাজির বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে হোটেলে যেয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পরিকল্পনা সেরে ফেলা। এরপর রোজার মাস, তিনি গেলেন বাসায়। নামাজ সেরে নিয়ে গেলেন সুনামকণ্ঠ কার্যালয়ে। ঢুকেই অবাক! একটা ছোট জেলার স্থানীয় পত্রিকার এমন আলিসান কার্যালয়। মনের অজানতেই বেরিয়ে এলো স্তুতি। এরপর করমর্দনে পরিচয় হলো পত্রিকাটির সম্পাদক বিজন দা’র সঙ্গে। কী দারুণ মানুষ! স্বল্প আলাপেই আপন করে নিলেন। এরপর হাত মিললো পাপন দা’র সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে নিরলস তিনি কাজ করে চলেছেন হত্যা-দুর্নীতির মতো বেসুরো সব বিষয়ের সঙ্গে। আরেকজন মহারথী তারেক ভাই। ভীষণ ছটফটে মানুষটি; ধোঁয়া উঠা আড্ডা জমলো তাঁর সঙ্গে। শামীম ভাই- কবি হিসেবে তাঁর লেখার সঙ্গে আগেই পরিচয়। কবিতার মতো সম্মুখেও দারুণ মানুষ তিনি। প্রতিবেদনের পরিকল্পনা তাঁদেরও জানালাম; একেক জন একেকভাবে পরামর্শ দিলেন। তবে অতিসন্ন্যাসীতে এখানে গাজন নষ্ট হলো না, বরং আরও সমৃদ্ধ হলো।
পরদিন থেকেই হাওরে নেমে পড়া। নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো আর প্রান্তিক মানুষগুলোর সঙ্গে আলাপন। সব মিলিয়ে একে একে ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোর পর্ব সজ্জিত হচ্ছে। তার মাঝে মেঘালয় পাহাড়ের হৃদয়গ্রাহী দৃশ্যের সঙ্গে আমিনুল ভাইয়ের কণ্ঠে করিমের গান। বাহ! ছবির মতো দিনগুলো। সন্ধ্যার পর আবারও সুনামকণ্ঠ অফিসে। নানা তথ্য নিলাম সেখান থেকেই। সুনামকণ্ঠের প্রতিটি উপজেলা প্রতিনিধি মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে গেলেন বাংলামেইলের প্রতিনিধি। তাঁদের লেখা প্রতিবেদন আর সংগৃহিত নানা তথ্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো আমার পকেটে থাকা নোটবুকটি। সফরের শেষ দিনেও হাওর আর সরকারি অফিসগুলোতে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করলাম। আর সন্ধ্যার পর সুনামকণ্ঠ পরিবার আমার হাতে তুলে দিলেন হাওর নিয়ে তাদের প্রকাশিত অর্ধশত প্রতিবেদন।
অবশেষে ফিরে এলাম ঢাকায়। জলের কান্না শিরোনামে বাংলামেইলে প্রকাশিত হলো সাত পর্বের দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রতিবেদন। যার প্রতিটির বুক চিড়ে ছিল আমিনুলের তোলা ছবি আর সুনামকণ্ঠ পরিবারের দেওয়া তথ্য। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল, আমি যেন সংবাদ সম্পাদনা করছি। সবই তো লিখেছেন সুনামকণ্ঠের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।
সময় পেরিয়ে যায়…নভেম্বর মাস এলো। কর্মস্থলের সঙ্গে শুরু হলো টানাপোড়েন। এরই মাঝে দ্বিতীয়বারের মতো ঘরে এলো ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড। অকৃতজ্ঞ প্রতিষ্ঠান বাংলামেইল তা নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেনি, যদিও তাঁদেরই অর্থায়নে সুনামগঞ্জ সফর ও ধারাবাহিক প্রতিবেদন। কিন্তু আমিনুল অভিনন্দন জানাতে ভুলেনি। ঐ যে বললাম, পেশাগত সম্পর্ক থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্কে মিশে গেছি আমরা। সুনামকণ্ঠও আমাকে মনে রেখেছে, পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটি গুরুত্ব সহকারে আমার ছবিসহ ছেপেছে।
আমি আজ সুনামকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রতিষ্ঠানটিকে জানাতে চাই শুভেচ্ছা। জানাতে চাই কৃতজ্ঞতা। সেই সঙ্গে বলতে চাই- এই প্রতিষ্ঠানটি পাশে না থাকলে হয়তো প্রতিবেদনটি সম্পন্ন হতো না। আর পুরস্কার সে তো দূর আকাশের তারা হয়ে থাকতো। পঞ্চকবির অন্যতম রজনীকান্তের মতো করে বলতে চাই “আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু/ কম করে মোরে দাওনি; / যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া/ কেড়েও তা কিছু নাওনি।।”
সবশেষে আবারও সুনামকণ্ঠকে অভিনন্দন। সেই সঙ্গে কবিসুরে বলতে চাই… “আমায় রাখিতে চাওগো বাঁধনে আটিয়া/ শতবার যাই বাঁধন কাটিয়া/ ভাবি ছেড়ে গেছ ফিরে চেয়ে দেখি/ এক পাও ছেয়ে যাওনি।”
[দীপন নন্দী : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক সমকাল]