১৩ থেকে ১৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা যখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উপর পড়ছে, কেঁপে উঠছে নগরী তখন ব্ল্যাকআউট এবং কারফিউর মধ্যে ঘাতক আলবদর, আলশামস, রাজাকাররা পূর্বপ্রণীত নীলনকশা অনুযায়ী মেতে উঠে বুদ্ধিজীবী হত্যায়। দেশের সেরা মেধাবী অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিকদের সশস্ত্র ঘাতকেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে হাত বেঁধে, চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় বধ্যভূমিতে। কাউকে আনলো ঘুম থেকে তোলে, কাউকে খাবার থেকে ডেকে নিয়ে, কাউকে কেড়ে আনলো শঙ্কিত পরিবারের মাঝ থেকে টেনে-হিঁচড়ে, প্রিয়তমা স্ত্রী, কন্যার সকল আকুতি উপেক্ষা করে। শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমদ, কবি আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য্য, ড. ফয়জুল, মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের, ড. মরতুজা, সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন, সেলিনা পারভীন, ড. ফয়জুল মহী, ড. আব্দুল আলীম, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার, ড. ফজলে রাব্বীসহ আরো অনেককে একরাতেই ঘাতকেরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এই নীলনকশা বাস্তবায়নকারী ঘাতকদের নেতারাও ছিল শিক্ষিত-মেধাবী, তবে ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীল। বাংলাদেশ যাতে মেধাশূন্য হয়ে মাথা উঁচু করে প্রগতির পথে অগ্রসর না হতে পারে, সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিজয়ের চূড়ান্ত সময়ে ঘটে এই পরিকল্পিত হত্যাকা-। আলবদর বাহিনী এবং আল শামস বাহিনী মূলত সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে। জন্মলগ্ন থেকেই এদের মন-মগজে এমন এক ধরনের উন্মাদনার বীজ রোপণ করে দেয়া হয় যে, ধর্মের নামে পাকিস্তান রক্ষায় এমন কোনো নিকৃষ্টতম, নিষ্ঠুরতম কাজ নেই যা তারা করতে পারে না। তাই করেছে তারা।
যুদ্ধ যখন শেষ পর্যায়ে তখন অপর প্রান্তে কূটনৈতিক যুদ্ধে জাতিসংঘে আমেরিকার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ভেস্তে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর ফলে। খবর পাওয়া যায় সিঙ্গাপুর অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে ঢুকছে মার্কিন সপ্তম নৌ-বহর। এই বহরে আছে পারমাণবিক শক্তিচালিত জাহাজ এন্টারপ্রাইজ। সঙ্গে এসেছে আরো সাতটি রণতরী।
ফরাসি সাহিত্যিক ও দার্শনিক আন্দ্রে মার্লো, যিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উদ্দেশ্যে একটি খোলাচিঠি লিখেন লা’ফিগারো পত্রিকায়। ‘আপনার বিমানবাহী রণতরী কলকাতাকে বিপন্ন করতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্র ওখানকার মৃত্যুমুখী শরণার্থী মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে পারে না। পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী সেনাবাহিনী যদি নগ্নপদ ভিয়েতনামীদের গুড়িয়ে দিতে সক্ষম না হয়, আপনি কি বিশ্বাস করেন ইসলামাবাদের সেনাবাহিনী ১২শত মাইল দূর থেকে স্বাধীনতা উদ্দীপ্ত একটি জাতিকে আবার দখল করতে পারবে। পৃথিবীর ভাগ্য যখন ঝুঁকির মুখে তখন বঙ্গোপসাগরে বিমানবাহী রণতরী পাঠানো কোনো যুক্তি নয়…।’
অপরদিকে কুড়িটি সোভিয়েত রণতরীও ভারত মহাসাগরে এসে জড়ো হয়েছে। জাপানের দক্ষিণ প্রান্ত ও কোরিয়া উপদ্বীপের মধ্যবর্তী সুসীমা প্রণালির ভেতর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একটি সোভিয়েত ফ্রিগেড এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে পারে এমন একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ বঙ্গোপসাগরের দিকে পাড়ি দিয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর দুই পরাশক্তি মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। ঠিকই যদি সপ্তম নৌবহর থেকে গোলাবর্ষিত হয় তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে এখান থেকেই। কলকাতা হবে এর প্রথম বলি। কিন্তু কলকাতার মানুষদের মধ্যে এ নিয়ে তেমন ভয়-আতঙ্কের কোনো ছায়া পর্যন্ত নেই। নিয়াজী সম্ভবত অপেক্ষা করছে দক্ষিণ দিক থেকে সাহায্য আসার। তাই এখনো ভূগর্ভস্থ বাংকারে ম্যাপের সামনে বসে হুঙ্কার দিচ্ছেÑ আমাদের সর্বশেষ সৈন্যটি জীবিত থাকা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। এক বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নে নিয়াজী বলেনÑ ঢাকার পতন ঘটবে আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে।
১৪ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় গভর্নর ড. মালিক মন্ত্রিপরিষদ, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠক চলাকালীন মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণ চালায় ঢাকায়। পাঁচটি বোমা পড়ে ঠিক গভর্নর হাউসে। হুড়োহুড়ি ছুটোছুটি পড়ে যায়। অবশ্য গভর্নর হাউসে বোমা ফেলার আগে মুজিবনগর সরকারের অনুমতি নেয় ভারতীয় বিমানবাহিনী। বিমান আক্রমণ শেষ হলে ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে আবার বৈঠক। চলে মাত্র পাঁচ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে ড. মালিক এবং তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে আশ্রয় নেয় রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তাদেরও হিড়িক পড়ে পদত্যাগের। জেনারেল স্যাম মানেকশ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে শেষবার্তা প্রেরণ করেন। এবং বেতার মারফত সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য ফ্রিকুয়েন্সিও জানিয়ে দেন। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত মিত্রবাহিনী কোনো বিমান আক্রমণ চালাবে না বলেও জানিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিবাহিনী-মিত্রবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে চারদিক ঘিরে রেখেছে। কিন্তু পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারছে না। মুক্তিবাহিনীর আর তর সইছে না। পারলে এখনই গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যান্টনমেন্টে। পাকিস্তানি সেনাদের মুক্তিবাহিনীকেই বেশি ভয়। এতোদিন এদেশের উপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, খুন-ধর্ষণ করেছে, তার বদলা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে নিতে পারে মুক্তিবাহিনী। ক’দিন ধরে বিভিন্ন ঘাঁটিতে পলায়নপর পাকিস্তানি সেনাদের মুখে একটি কথা শোনা যেতÑ স্যারেন্ডার করুঙ্গা, মগর মুক্তিকো পাস ন্যাহি। হিন্দুস্থানি ফৌজকো পাস করুঙ্গা।
শেষ চেষ্টা করেও আর কোনো ফল হল না। এতোদিন যে ভরসা দিয়ে রাখছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখন তা-ও আর পাওয়া যাচ্ছে না। সপ্তম নৌবহরও নাকি কলম্বোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। হিমালয়ে বরফ পড়ে যাওয়ার অজুহাত তুললো চীন। বিকেলে ইয়াহিয়া খানের বার্তা এসে পৌঁছে। যেহেতু আর প্রতিরোধ সম্ভব নয় এবং চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই, যুদ্ধ বন্ধ করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করো। এই বার্তাকেই আত্মসমর্পণের সম্মতি বিবেচনা করে ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাপ্রধানের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠায় নিয়াজী। মিত্রবাহিনী বিমান থেকে বিভিন্ন ভাষায় আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে। যুদ্ধবিরতি নয়- নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে। নিয়াজীর যুদ্ধের খায়েশ মিটে গেছে। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে সম্মত হয় পাকিস্তানি বাহিনী।
নিয়াজীর শেষ অনুরোধÑ আত্মসমর্পণের সময়সীমা ৬ ঘণ্টা বাড়িয়ে দিতে। তাই দেয়া হল। সকাল থেকেই মানুষজন বেরিয়ে আসছে রাস্তায়। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে মুক্তিবাহিনী, মিত্রবাহিনীর দিকে। ভারতীয় ট্যাংকের উপরও উঠে যাচ্ছে কেউ কেউ। আজ ঢাকায় কোনো যুদ্ধ নেই, তবে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির শব্দ আছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের উল্লাসে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে জনতার অভিনন্দনের জবাব দিচ্ছে।
অবশেষে বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকায় অবস্থানরত সকল পাকিস্তানি অফিসার এবং সৈন্যদেরকে নিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন লে. জেনারেল নিয়াজী আর প্রতিস্বাক্ষর করে তা গ্রহণ করেন যৌথবাহিনীর পক্ষে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। যে জায়গায় ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন ঠিক সেখানেই উন্মুক্ত প্রান্তরে আত্মসমর্পণের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল কাদের সিদ্দিকীর আগ্রহে। আত্মসমর্পণের নিয়ম অনুযায়ী কাঁধ থেকে পদবীসূচক ব্যাজ ছিঁড়ে ফেলেন নিয়াজী। কোমরের বেল্ট থেকে রিভলবার খোলে এবং গুলি বের করে সমর্পণ করেন যৌথবাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা’র কাছে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন উপপ্রধান সেনাপতি উইং কমান্ডার এ.কে. খন্দকার। আরো ছিলেন কাদের সিদ্দিকী, মেজর হায়দর, ফ্লা. লে. আবু ইউসুফ খান। মিত্রবাহিনীর পক্ষে মেজর জেনারেল স্বগত সি, মেজর জেনারেল নাগরা, মেজর জেনারেল জেকব, ভাইস এডমিরাল কৃষ্ণান, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। সবাইকে অবাক করে দর্শক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন আরেকজন। নিরাপত্তার ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে লে.জে. অরোরার সঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী ভান্তি অরোরা। শতশত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক আর ছিল হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ যারা পাকবাহিনীর উদ্দেশ্যে ঘৃণা আর থুথু নিক্ষেপ করছিল। হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জামশেদ, ব্রিগেডিয়ার বকরসহ ১শ জন অফিসার অস্ত্র সমর্পণের প্রতীক হিসেবে নিজেদের রিভলবার খুলে সামনে মাটিতে রেখে দেয়। মিত্রবাহিনী আত্মসমর্পণ পর্ব সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত পাকিস্তান বাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জনতার ক্ষোভ হতে রক্ষা করে। অবশেষে ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করলো বিভিন্ন জায়গায়।
মুক্ত আকাশে নতুন সূর্য উঠে। হেমন্তের সোনালী রোদে আলোকিত দশদিক। নতুন চোখে দেখা দিল মুক্ত বাংলাদেশ। ক্ষত-বিক্ষত, দগ্ধ-রক্তাক্ত, বাতাসে লাশের গন্ধ। লাঞ্ছিতা জননীর ছিন্ন-ভিন্ন সবুজ আঁচলে রক্তমাখা সূর্য নিয়ে চারদিকের আকাশে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। বিজয়ের আনন্দে মিশে আছে কতো অশ্রু, কতো ক্রন্দন, হাহাকার আর লাঞ্ছনা।