১৯৭০ সাল। সুনামগঞ্জ কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের বাংলা কম্বাইন্ড ক্লাস ৭ নম্বর রুম শ’তিনেক ছাত্রছাত্রীতে ঠাসা। ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের করিমবক্স জয়গুনের একান্ত কথোপকথনের গোপন রহস্য উন্মোচনে বাংলা স্যারের সরস আলোচনায় নিস্তব্ধ ক্লাস রুম। এরই মাঝে ছন্দপতন মে আই কাম ইন স্যার। উস্ক কুষ্কু চুল, শ্রান্ত ঘর্মাক্ত মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে তালেব। সুনামগঞ্জের ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অবস্থান তখন ততটা ভাল নয়। জাগো জাগো বাঙ্গালি জাগো, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা আর অগ্নিমন্ত্র জয়বাংলা স্লোগান তুলে ছাত্রলীগের একটি মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলায় নিবেদিত তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক তালেব উদ্দিন আহমদ। সময়মতো আসতে পারে না ক্লাসে। প্রায়ই লেট।
চোখ ফিরিয়ে দেখে, চরম বিরক্ত স্যার বুকের বোতাম লাগিয়ে এসো। অপ্রস্তুত তালেব সলাজ হাসির রক্তিম মুখে মাথা নিচু করে সার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ক্লাসে ঢুকে। হলজুড়ে অষ্পষ্ট গুঞ্জন ‘জয়বাংলা’।
জয়বাংলা অন্তপ্রাণ তালেবকে দেখলে প্রায়ই এমন উচ্চারণ সহপাঠীদের মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতো মনের অজানতেই। সদাব্যস্ত তালেব মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে গানও গাইতো। গলায় সুর ছিলনা। প্রাণের আবেগ দিয়ে ‘জয়বাংলা জয়ধ্বনি দিলে ইসলাম যায়গা চলে, এটা বলে কোন পাগলে…।’
স্বাধীনতার ডাকে সেই তালেবতো যুদ্ধে যাবেই। তবে গিয়েছিল ট্রেনিং ছাড়া। মঙ্গলকাটার সামনাসামনি যুদ্ধে গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরাপড়ে তালেব। আর সুনামগঞ্জ মুক্ত হলো সপ্তাহ খানেক পরে। পিটিআই সেনা ক্যাম্পে তার ওপর চলে একটানা নির্মম নির্যাতন। জুবিলী স্কুলের মাঠে প্রকাশ্য সভা ডেকেও পাশবিক নির্যাতন করে বর্বর পাকসেনা এবং ততোধিক হিংস্রতা প্রদর্শন করে দেশীয় দালালেরা। সর্বদা হাসিমাখা তালেবের মুখমণ্ডল রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, বিকৃত করে দেয় নরপশুরা। তবু জয়বাংলা ত্যাগ করে পাকিস্তান জিন্দাবাদ উচ্চারণ করেনি সে মুখে। সুনামগঞ্জ মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে ৬ ডিসেম্বর পিটিআইয়ের আস্তানা ছেড়ে পালিয়ে যাবার পথে সেনারা তালেবকে হত্যা করে ফেলে যায় আহসানমারাতে। সঙ্গে আরো দুই বন্দীযোদ্ধা। একজন কৃপেন্দ্র দাস অন্যজন নাম না জানা চা শ্রমিক।