1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩০ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

জ্যোতির্ময় প্রভা শ্রীকান্ত দাশ : তাপসী চক্রবর্তী লিপি

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৭

মহৎ কাজের মধ্যেই মানুষ অমর হয়। স্বপ্নীল পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান ক্ষণকালীন। পৃথিবীর পান্থশালায় দু’দিনের অতিথি হয় মানুষ। এক সময় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হয়। এই চলে যাওয়ার মাঝে কতজন মানুষ তার কৃতিত্বের ছাপ রেখে যেতে পারে পৃথিবীর বুকে? শুধুমাত্র মহৎ কর্ম দ্বারা মানুষ অমরত্ব লাভ করতে পারে। মানুষের মৃত্যু হয় সত্য কিন্তু তার কর্মের মৃত্যু নেই।
কীর্তিমান মানুষের মৃত্যু নেই। কমরেড শ্রীকান্ত দাশের মৃত্যু হয়েছে সত্য কিন্তু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি রেখে গেছেন অমর কীর্তি। মরণোত্তর দেহ দান করে সিলেটের ইতিহাসে যেমন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তেমনি মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন। ভাবতে অবাক লাগে, কত উদার তাঁর হৃদয়, কত স্বচ্ছ সুন্দর তাঁর মন-মানসিকতা। এই দেশের কাদা-মাটি-জলে তিনি বড় হয়েছেন। ভাটি বাংলার উদার উন্মুক্ত পানি আর বাতাসে তিনি বেড়ে ওঠেছেন। চিনেছেন মাটি আর মানুষের মায়া-মমতা। আপন গতিতে এগিয়ে গেছেন আগামীর দিকে। সুস্থ সমাজ গঠন করার লক্ষ্যে আজীবন লড়েছেন।
গণসংগীত শিল্পী, শাল্লা উদীচী’র সাবেক সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শ্রীকান্ত দাশ-এর সমাজের প্রতি ছিল দায়বদ্ধতা। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ছিল তাঁর রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা। জীবন চলার স্বচ্ছ মনমানসিকতা। যার দরুন যুগোপযোগী সাহসী পদক্ষেপ নিতে বিচলিত হননি। ২০০৪ সালের ৬ অক্টোবর নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নিজের দেহ দান করার ঘোষণা করেনÑ ‘আমার মৃত্যুর পর চোখের মালিকানা হবেন সন্ধানী ও দেহের মালিকানা হবেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাঁর মরদেহ সংগ্রহ করে চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনে ব্যবহার করার অধিকারী হবেন। আমার নশ্বর দেহ যাতে মানব জাতির কল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে একটি বিজ্ঞানমনস্ক আলোকিত সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য আমার এ ঘোষণা।’
মানব দরদী বিজ্ঞানমনস্ক এ মানুষটি ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। আজীবন মানবতাবাদী শ্রীকান্ত দাশের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মরদেহ ২০ নভেম্বর ২০০৯-এ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে হস্তান্তর করা হয়। সিলেটের মাটিতে এই প্রথম ব্যক্তি স্বেচ্ছায় দেহদানের মাধ্যমে সিলেটের ইতিহাসে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মানবের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকার এক ইতিহাস রচনা করেন। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রাণ’ কবিতার কথা মনে পড়েÑ
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।
শ্রীকান্ত দাশের জন্ম ৫ জুলাই ১৯২৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার আঙ্গারুয়া গ্রামে। বাবার নাম যোগেন্দ্র কুমার দাশ, মায়ের নাম জ্ঞানদায়িনী দাশ। জগন্নাথপুরের সোনাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুরেশ চন্দ্র রায়ের কাছে প্রথম শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এ বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর দিরাই থানার লউলারচর মধ্যবঙ্গ স্কুলে এবং পরে নবীগঞ্জ হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পরেন। বরেণ্য রাজনীতিবিদ কমরেড বরুণ রায়ের বাবা করুণাসিন্ধু রায়ের কাছে ১৯৪৩ সালে রাজনীতিতে তালিম নিয়ে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে থাকায় পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মাস্টার মশাইয়ের সাথে মিছিলে যোগ দিয়ে “বন্দে মাতরম” স্লোগান দিতেন। শ্রীকান্ত দাশ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
জীবন সংগ্রামী এ বীর জীবনের বাঁকে বাঁকে যুদ্ধ করে জীবন যাপন করেছেন। কলকাতায় দর্জি শিক্ষা গ্রহণ দর্জির কাজ করতেন। পরে আজমিরীগঞ্জে যেমন টেইলারের চাকরি করেন তেমনি পরে দোকান কর্মচারীরও কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় তিনি নানা পেশা গ্রহণ করেছেন। একসময় কুমিল্লায় ব্র্যাকেও চাকরি করেছেন। নিজের বাড়িতে বসে টেইলারি করে সংসার চালিয়েছেন।
জীবনে চলার পথে নানা ঘটনা নানা সময় তাঁর জীবনে ঘটেছে। ১৯৫০ বাংলার ফালগুন মাসে [১৯৪৩/১৯৪৪সাল] সুরমা উপত্যকায় ৮ম কৃষক সম্মেলন-এ তিনি প্রথম গণসংগীতে যোগ দেন।
হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার বাল্লা জগন্নাথপুরে এক মাসব্যাপী গণসংগীত, পথসভা, হাট-সভা, গ্রামীণ বৈঠক ইত্যাদিতে তিনি যোগ দেন। ১৯৪৪/১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায়, “অল ইন্ডিয়া কৃষক সম্মেলন”-এ তিনি যোগ দিয়েছিলেন। আর এ সম্মেলনে যোগদান তাঁর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য স্মৃতিময় ঘটনা।
কখনো গান কখনো নাটক কখনো মিছিল অর্থাৎ প্রয়োজনের তাগিদে যে সময় যা প্রযোজ্য তাই করে যেতেন। পথনাটকে অভিনয়ও তিনি করেছেন। নাটকটির নাম হচ্ছে “মুই ভূখাহো”। এ নাটকে নরকঙ্কাল কিশোরের ভূমিকায় অভিনয় করে বন্দী হন। চব্বিশ ঘণ্টা পর অবশ্য মুক্তি লাভ করেন।
জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত এ মানবাতাবাদী ব্যক্তি জীবনের পরতে পরতে সংগ্রাম করে এগিয়ে গেছেন। এ সংগ্রাম যেমন শোষকের বিরুদ্ধে, জোতদারের বিরুদ্ধে তেমনি এ সংগ্রাম ছিল বাঁচার সংগ্রাম-জীবন সংগ্রাম। ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। স্ত্রী-সন্তানদের সুস্থ-সুন্দর জীবন গড়ার লক্ষ্যে সত্য ন্যায় সুন্দরের পথে থেকে সংগ্রাম করেছেন। মনে তাঁর অফুরন্ত প্রত্যয়Ñ
এ লড়াই বাঁচার লড়াই/ এ লড়াই জিততে হবে
এ লড়াই মরণজয়ী করতে হবে রে।
তাই দুঃখের পথ চলায় আনন্দের স্মৃতিকে বুকে আগলে ছিলেন চিরদিন। ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারতের মেঘালয়ে পরিমল হাজং-এর মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির সাথে করমর্দনের স্মৃতি তাঁর জীবনের আনন্দের স্মৃতি। শ্রীকান্ত দাশের কণ্ঠ থেকে যে গণসংগীত নিঃসৃত হতো তা যেমন সোচ্চার কণ্ঠের ধ্বনিত হত তেমনি কোমলতার ¯পর্শে বিশেষ ভঙ্গিমা লাভ করতো।
বাম রাজনীতির যে কোন সভা অনুষ্ঠানে শ্রীকান্ত দাশের কণ্ঠে যে গণসংগীতগুলো বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তাঁর মধ্যে এ গানটি উল্লেখযোগ্যÑ
‘কাউয়ায় ধান খাইলরে
খেদানোর মানুষ নাই
কামের বেলা আছে মানুষ
খাইবার বেলা নাই।
মানব দরদী মহৎ এ ব্যক্তির দরাজ কণ্ঠে গান শোনার ভাগ্য আমার হয়েছিল সেই ছেলেবেলা থেকে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে আগপাড়ায় অ্যাডভোকেট কানন পালের বাসায় এবং মিরাবাজার আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে গানের আসর বসতো। আমার মা যখন গান গাইতেন ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণ ভাইরে’ অথবা ‘লাঙ্গল চালাই আমরা কোদাল চালাই’ তখন এ গানগুলোর সাথে শ্রীকান্ত দাশ কণ্ঠ মেলাতেন। কারণ তাঁরা দু’জনেই একই রাজনীতির অনুসারী ছিলেন। ঘটনাক্রমে নানা স্মৃতি আজ মনে পড়ে। সেই ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দশ লক্ষ বাঙালির জীবন প্রদীপ যখন নিভে যায় তখন বিবেকবান বাঙালির প্রাণ কেঁদে ওঠেছিল। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সারাদেশের মানুষ একযোগে সাহায্যের হাত বাড়ায়। তাৎক্ষণিকভাবে একটি গান রচনা করেন এবং এ গানের সুরারোপ করেন শ্রীকান্ত দাশ আমাদের মিরাবাজার বাসায় বসে। গানটি হলÑ
ভিক্ষা দাওগো নগরবাসী
দাও গো ভিক্ষা দাও।
দুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে সিলেট শহরে প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে বিরাট শোক মিছিল বের করেছিল। সেই মিছিলে মহিলা পরিষদ থেকে এ গানটি মা গেয়েছিলেন। মায়ের সাথে অনেকেই সেদিন এ গানে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন।
নিরহংকারী শ্রীকান্ত দাশ অত্যন্ত সাবলীলভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করতেন যে কোন পরিবেশে। খুব সুন্দরভাবে তিনি নিজেকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতেন। আমার মনে আছে ২০০৩ সালে সোপান থেকে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে শিশুরা গান গেয়ে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ শ্রীকান্ত দাশ পশ্চিম দিক থেকে রিকসায় এসে সোপানের মিছিলে অংশ নিলেন। কোন ভাবনা চিন্তা না করে পায়ের স্যান্ডেল জোড়া বগলে তুলে নিয়ে নগ্ন পায়ে হেঁটে হেঁটে গান ধরলেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’।
১৪০৯ বাংলা (২০০২ সাল)-এর ১লা বৈশাখ (১৪এপ্রিল) সোপান শিশুদের চারু, নৃত্য, তবলা, গিটার, আবৃত্তি ও সঙ্গীত বিদ্যালয় থেকে এই অসীম সাহসী ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শ্রীকান্ত দাশকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। প্রত্যেক মানুষের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। আছে মহৎ মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। শ্রীকান্ত দাশ সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের সামনে রেখে গেলেন। মানুষের মনে জাগিয়ে দিয়ে গেলেন কর্তব্য পালনের গুরুভার। এ মহৎ মানুষটির কর্তব্য কর্ম ও কীর্তি প্রদর্শনের প্রতি বিন¤্রচিত্তে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা।
‘সনাতন জীর্ণ কুআচার, চূর্ণ করি…’ তিনি হয়েছেন অমর। তাঁর জ্যোতির্ময় প্রভা ছড়িয়ে পড়ুক বিবেক থেকে বিবেকে। জাগুক তাঁর অনুসারী। হে সাহসী সৈনিক আপনাকে সালাম লাল সালাম।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com