“ফিরে এলো আজ সেই মুহররম মাহিনা,
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।”
ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহররম। মুহররম মাসের ১০ তারিখে অনেকগুলো তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা সংগঠিত হওয়ায় দিনটি ইসলামের ইতিহাসে অসাধারণ গুরুত্বে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই দিনটিকে আশুরা নামে অভিহিত। আশুরার মরতবা ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। এই দিনে শুধু কারবালার মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদায়ক ঘটনাই সংগঠিত হয়নি, ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে হযরত হুসাইন (রহ.) শাহাদাত বরণ করার শোকাবহ ঘটনা এই দিনটিকে একটি অনন্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করে। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন মানুষ গভীর শোক-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় এই দিনটিকে স্মরণ করবে। কোন মহাপ্লাবনেও এই দিনের শোকাবহ ঘটনা মানুষ বিস্মৃত হবে না। স্থূল দৃষ্টিতে কারবালায় ইয়াজিদের জয় হলেও প্রকৃত বিজয় হয়েছে হযরত হুসাইন (রহঃ) এর। সত্য ও ন্যায়ই বিজয় মুকুট লাভ করে।
কারবালার নির্মম ও নৃশংস ঘটনা আজ পর্যন্ত যত অশ্রু ঝরিয়েছে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত অন্য কোন ঘটনা সেই পরিমাণ অশ্রু ঝরাতে পারেনি। এ নির্মম ও নৃশংস শাহাদাত মুসলিম উম্মাহ যেভাবে শোকাতুর হয়েছে এবং যে রূপ নানাভাবে ও নানা রূপে শোক প্রকাশ করেছে, মাতম করেছে এর কোনো নজির ইতিহাসে নেই। এই ঘটনায় হযরত হুসাইন (রহ.) ইতিহাসে স্মরণীয়-বরণীয় ও মৃত্যুঞ্জয়ী চিরঞ্জীব হয়েছেন আর ইয়াজিদ হয়েছে ধিকৃত। আজও মানুষ কারবালার ঘটনার জন্য ফুঁসে উঠে। এইদিনে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে তার মধ্যে লাওহ, পাহাড়-পর্বত এই আশুরার দিনেই সৃষ্টি করা হয়েছে। হযরত আদম (আ.) এর সৃষ্টি এই দিনেই। এই দিনেই তাঁকে বেহেশতে স্থান দেয়া হয়েছে, আবার এ দিনেই তাঁকে বেহেশত থেকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এই দিনে ভূমিষ্ট হয়েছেন এবং এ দিনেই হযরত তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করতে নিয়েছিলেন। নূহ (আ.) এ দিনেই মহাপ্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পাবার পর জাহাজ থেকে পৃথিবীর মাটিতে অবতরণ করেন। হযরত ইদ্রিছ (আ.) সুদীর্ঘ রোগভোগের পর এ দিনেই রোগ মুক্ত হয়েছেন। হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে এ দিনেই রক্ষা পান। হযরত ইব্রাহীম (আ.) নমরুদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে ৪০ দিন অবস্থানের পর আল্লাহর অপার রহমত ও কুদরতে সহাস্যে বেরিয়ে আসেন। আর এ দিনেই হযরত মুসা (আ.) ফেরাউনের বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করেছিলেন বনী ইসরাইল সম্প্রদায়কে এবং ফেরাউন তার বিশাল সৈন্যবাহিনী সহ লোহিত সাগরে সলিল সমাধি লাভ করে। এ দিনেই হযরত ঈশা (আ.) কে আল্লাহ পাক তাঁর শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করেন এবং সশরীরে তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেন। এ দিনেই হযরত দাউদ (আ.) ক্ষমা লাভ করেন এবং হযরত সোলায়মান (আ.) এ দিনেই তাঁর হারানো রাজত্ব পুনরায় লাভ করেছেন। কিয়ামত সংগঠিত হবে এই আশুরার দিন। অলিকুল শিরোমনি গাউসুল আজম আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) রচিত ‘গুণিয়াতত্ব ত্বালিবীন’ পুস্তকের মতে এই দিনে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) এর রূহ মোবারক সৃষ্টি করা হয়েছিলো বলে ৩২৮ পৃষ্ঠায় এই তথ্য লিপিবদ্ধ আছে।
আশুরার দিনেই উল্লেখিত তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনাগুলো সংঘটিত হওয়ায় এ দিনটি একটি অনন্য ও বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। সর্বশেষ ঘটনা হচ্ছে কারবালা ময়দানের নির্মম, নৃশংস ও হৃদয়বিদারক ঘটনা।
গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই ইহুদীরাও এ দিনে সিয়াম পালন করত। এভাবে যতগুলো ঘটনা আশুরার দিনে সংগঠিত হয়েছে সবগুলোই সমগ্র উম্মার জন্য। গোটা মানবম-লির জন্য ছিল এই সব রহমত স্বরূপ। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সিয়াম ইহুদীরা কেবল আশুরার দিনেই সিয়াম পালন করতো। ইহুদিদের সিয়াম পালনের সাথে পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য নবী করিম (স.) আশুরার দিবসের সাথে নবম দিবসেও অর্থাৎ ৯ ও ১০ই মহরম সিয়াম পালনের নির্দেশ প্রদান করেন। এই সিয়াম পালন অত্যন্ত বরকতময়।
[লেখক : সিনিয়র আইনজীবী ও কলামিস্ট।]