1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪২ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

১৫ আগস্টের বিভীষিকা ও সুনামগঞ্জ : এডভোকেট সালেহ্ আহমদ

  • আপডেট সময় সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৭

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ কি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে? জয়বাংলা ধ্বনিতে উজ্জীবিত কোটি কণ্ঠের উত্তর হবে না, পারে না। কেননা বঙ্গবন্ধু মানুষকে খুব ভালবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। তাঁর ভালবাসা ও বিশ্বাস ছিল অকৃত্রিম। বঙ্গবন্ধুর অমর সৃষ্টি স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ মহানায়ককে হত্যা করতে পারে তা তো কল্পনায়ও ছিল না। সে সময় বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্ত বিহঙ্গের মত ছিল। এরই মধ্যে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাত্র ৩ (তিন) বছরের মাথায় ঘাপটি মেরে থাকা কিছু হায়েনা, গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী সামরিক লোকের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৯৭৫ সালের আগস্টে ৩২ নম্বরে থাকা পরিবারের সদ্যস্যসহ খুন করে ফেলে। হতচকিত, বিমূঢ়, স্তব্ধ হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। সারা বিশ্ব স্তম্ভিত। অনেক রক্ত, অনেক যুদ্ধ, অগণিত মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে প্রাপ্ত মুক্ত বাংলায় বঙ্গবন্ধুর লাশ খুবই বেমানান ছিল।
এই হত্যাকাণ্ডে পুরো দেশের মত আমাদের এই প্রান্তিক শহরের লোকজনের কথাবলা যেন বন্ধ হয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব প্রাথমিক অবস্থায় আত্মগোপনে চলে যান। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন তখন সুনামগঞ্জে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন হিসেবে সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আওয়ামী লীগের আব্দুর রইছ এমপি, আব্দুজ জহুর এমপি, ন্যাপের আলফাত উদ্দিন আহমদ, আলী ইউনুছ, কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর মহকুমা সম্পাদক নজির হোসেন এবং বরুণ রায় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে সিলেট অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৭৬ সালে কাদের বাহিনীর তৎপরতা সুনামগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। সংগ্রামী লোকজন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সশস্ত্র প্রতিবাদে সংগঠিত হতে থাকে। সে সময়ে সুনামগঞ্জের তৎকালীন মোহনপুর ইউনিয়নের শাখাইতি গ্রাম নিবাসী ডা. রাধিকা রঞ্জন তালুকদার ও ফণী ভূষণ তালুকদার-এর পরিবার ছিল অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মধ্যে একটি। পরিবারটি মুক্তিযুদ্ধের ও বাম রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কমরেড নজির হোসেন, রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু ও ইসলাম উদ্দিন কয়েকদিন আত্মগোপনে তাঁদের বাড়িতে ছিলেন। একরাতে ধর্মপাশা থানার রাঙ্গামাটি সাকিনের সুকেশ সরকার তার ছোট দল নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় উক্ত বাড়িতে অবস্থান গ্রহণ করেন। সম্ভবত সুকেশ সরকার ও তাঁর দল সুনামগঞ্জ শহরের মধুমিতা হোটেলের গলিতে, পুরাতন বাসস্টেশন এবং আসানমারা ফেরিঘাটে গ্রেনেড/বোমা চার্জ করে। শহর থেকে বিচ্ছিন্ন মরাটিলার দিকে একদিন গুলি বর্ষণের শব্দ শুনা যায়। পরবর্তীতে আশ্রয়দানের কারণে শাখাইতি গ্রামের ডা. রাধিকা রঞ্জন তালুকদার গ্রেপ্তার হন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এই অবস্থাপন্ন পরিবার সে সকল মামলা-মোকদ্দমায় একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এই পরিবারটি আর দাঁড়াতে পারেনি।
ধর্মপাশা থানার উত্তর বংশীকুণ্ডা ইউনিয়নের কালাগড় গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল হক-এর সাথে যোগাযোগ ক্রমে চমকপ্রদ তথ্য জানা যায়। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সনে ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাঁর কিশোর মনে দারুণ রেখাপাত করে। দ্বিধাহীন চিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়েন রক্তাক্ত লড়াই মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর পর তিনি ভেঙ্গে পড়েন। কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারেননি। সংসার পরিবার সবকিছু ছেড়ে খবরাখবর করে মহেষখলায় ভারত সীমান্তবর্তী স্থানে কাদের বাহিনীতে যোগ দেন। তার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন কলমাকান্দা থানার কেশবপুরের সুকুমার বাবু।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল হক অশ্রুসজল কণ্ঠে বলে গেলেনÑ বাংলাদেশ আছে কিন্তু তার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু নাই, এ আমি মানি না। মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকতে মহানায়কের মৃত্যু আমাকে আবারো অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করে। কাদের বাহিনীতে তাঁর সহযোদ্ধা সাচনাবাজারের হরকুমার বাবু, মধ্যনগরের অধীর চৌধুরী, চামরদানীর পীযূষকান্তি তালুকদার, কাইতকান্দা গ্রামের প্রমোদবাবু, দক্ষিণ বংশীকুণ্ডার সুবল দাস, চামরদানীর আ. বারেক, মহেষখলা সাউদপাড়ার ইছাক আলী, জামালপুরের ইউসুফ আলী, কালাগড়ের ক্বারী আব্দুর রহমান, কাইতকোনার প্রাণেশ চন্দ্র হাজং, মহেষখলার খোরশেদ আলম-এর মুখচ্ছবি এখনও তার মনে জ্বল জ্বলে আছে। তাঁর দলের নেত্রকোনার ঝন্টু এবং শ্যামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মো. রজব আলী বঙ্গবন্ধুর জন্য শহীদ হওয়ায় তিনি গর্ববোধ করেন। অন্যান্য সূত্রে গঙ্গাধরপুরের সত্যরঞ্জন তালুকদার, চামরদানীর অজিত চৌধুরী, সুধীর সরকার, মধ্যনগর সানুয়ার গ্রামের প্রমোদ রঞ্জন তালুকদার, কলমাকান্দার কেশবপুর গ্রামের বাবুল তালুকদারসহ দিরাই, শাল্লা, মধ্যনগর-এর উল্লেখযোগ্য তরুণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জীবনবাজি রাখেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সনে আমাদের সুনামগঞ্জ শহরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে আব্দুর রইছ এমপি, আব্দুজ জহুর এমপি, আলফাত উদ্দিন আহমদ (মোক্তারসাব), আলী ইউনূছ এডভোকেট, খলিলুর রহমান চৌধুরী এডভোকেট, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আমজাদ এডভোকেট, বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা এডভোকেট, বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.ত.ম. সালেহ, শৈলেন চ্যাটার্জী, আছদ্দর আলী চৌধুরী মোক্তার, প্রফেসর বিপ্রেশ দত্ত, প্রফেসর আব্দুল মতিন গ্রেপ্তার ও কারানির্যাতন ভোগ করেন।
সে সময় ছাত্র ইউনিয়নের সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখার সভানেত্রী রানী রায়কে গ্রেপ্তারের জন্য বাসা রেইড করার পর তাঁকে না পেয়ে তাঁর ভাই অধীর রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়। কমিউনিস্ট নেতা রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু বাবুকে বাসায় না পেয়ে তার বাবা রসময় দে-কে গ্রেপ্তার করা হয়। জামাই পাড়ার টুটন ও টুকনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমদিকে শৈলেন চ্যাটার্জীকে না পেয়ে তার ছেলে সমীর চ্যাটার্জীকে জেলরোডের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
আপ্তাব উদ্দিন এডভোকেট সাহেবকে সে সময় গ্রেপ্তার করা হয়। তার বাসায় একটি সালিশী বৈঠককে পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যে রাজনীতি সম্পৃক্ত করায়, আবার কারো কারো মতে আপ্তাব উদ্দিন সাহেব তখনকার নির্ভরযোগ্য আইনজীবী হওয়ার কারণে সমসাময়িক ক’জন আইনজীবী আইনের বিচক্ষণতায় তার মত পারদর্শী হতে না পারায় রুষ্ট ছিলেন। ধীরস্থির, সুন্দর উপস্থাপনার জন্য আপ্তাব উদ্দিন এডভোকেট সাহেবকে প্রিন্সিপাল বলা হতো। পেশাগত ঈর্ষার কারণে প্রভাবশালী মিছবাহউদ্দোজা আহমদ রেজা এডভোকেট ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনে আপ্তাব উদ্দিন সাহেবকে গ্রেপ্তারে ভূমিকা রাখেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। আপ্তাব উদ্দিন এডভোকেট সাহেব সে সময় গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।
১৯৭৫-এর সমসাময়িক সময়ে সুনামগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন জনাব তারেক। তার বাবা ও ষাটের দশকের প্রথম দিকে সুনামগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন। জনাব তারেক-এর ছাত্র জীবনের বেশ কিছু সময় সুনামগঞ্জে হওয়ায় সমবয়সী অনেকেই তাঁর বন্ধু ও ক্লাসমেইট ছিলেন। পরবর্তীতে ভিতর-বাইরের অনেক তথ্য জানা যায়।
আব্দুর রইছ এমপি সাহেবসহ নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তারের পর আব্দুর রইছ এমপি সাহেবের স্ত্রী-এর বড় বোন সফিকুন নেছা চৌধুরী (গুল বদন) হাসননগর বাসা থেকে সুনামগঞ্জ থানা পর্যন্ত হেঁটে এসে থানার সম্মুখে উচ্চস্বরে পুলিশের গ্রেপ্তার-হয়রানির প্রতিবাদ করেন। পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁর এই প্রতিবাদী সাহসী উচ্চারণ সমবেত সকলকে উজ্জীবিত করে। সফিকুন নেছা চৌধুরী (গুল বদন)’র স্বামী ছিলেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের আইন সচিব ও পরবর্তীতে জেলা ও দায়রা জজ জনাব আব্দুল হান্নান চৌধুরী।
এছাড়া সুনামগঞ্জ মধ্যবাজারের অমকর নাথ রায়, সুনামগঞ্জ আলেয়া ফার্মেসির সুকেশ পুরকায়স্থ (সুখু মামা), জামালগঞ্জের ছাদেক আলী চেয়ারম্যান সাহেব, বীর মুক্তিযোদ্ধা সীতেশ রায় (তাহিরপুর), মনোরঞ্জন রায় (তাহিরপুর), তাহিরপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান রমেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, কামলাবাজ গ্রামের নিশিরঞ্জন কর, সাচনা বাজারের রতীশ রঞ্জন দে, দিরাই চণ্ডীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান, দিরাই দোওজ-এর রণদাপ্রসাদ রায় চৌধুরী, চণ্ডীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ মিয়া, দিরাই রাধানগরের রমজান মিয়া তালুকদার গ্রেপ্তার ও কারা নির্যাতন ভোগ করেন। সুনামগঞ্জ মহকুমার সে সময়কার প্রতিটি থানার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ করেছেন।
এ সকল তথ্য এখন বিস্মৃতির তলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। কোন কোন স্থান থেকে চেষ্টা করেও সময়মত তথ্য না পাওয়ায় লিপিবদ্ধ করা গেল না। ভবিষ্যতে সংযুক্ত করার ইচ্ছা রইল।
আজ বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ এগিয়ে চলছে। মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অমর, অজেয়, অক্ষয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com