মাহমুদুর রহমান তারেক ::
হাসেনা খাতুন। তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের রামজীবনপুর গ্রামের গৃহিণী। দুপুরের ভাত রাঁধছিলেন। কিন্তু ভাতের সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের কি খাওয়াবেন তা ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না। কারণ দু’মুঠো ভাত যোগাড় করতে পারলেও কপালে তরকারি জুটেনি।
শুধু হাসেনা খাতুন নয়, ফসল হারিয়ে হাওরাঞ্চলের নিঃস্ব মানুষগুলো অর্থের অভাবে ঠিকমত খেতে পারছেন না। মরিচ ভর্তা, আলু পুড়া, পানি ভাত খেয়েই দিন কাটছে তাদের। সরকার থেকে যে সহায়তা করা হচ্ছে তাও খুব সামান্য বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
একই গ্রামের আছিয়া বেগম বলেন, প্রতি বছর ধান ঘরে উঠলে এই সময়ে ঘরে ভাল খাবার থাকতো, এই বারের অবস্থা খুব খারাপ। বাড়ির পাশে নদীতে যদি মাছ ধরা পড়লে তাহলে রুজি-রোজগার হয়। আর সবজি, মাছ কেনার মত টাকাও নাই। আয় নাই খাইতাম ক্যামনে। মরিচের ভর্তা, ডাইল, পানি ভাত খেয়ে দিন পার করতে হয়।
মনরাজ বেগম বলেন, বিপদেই আছি, একবার খাইলে আরেকবার খাওন নাই। এই বছর পানির নিচে সব ধান গেছে গা, এখন হাওরে মাছ কম, রুজিরোজগারও প্রায় বন্ধ। খরচ করার মত টাকা-পয়সাও নাই। ভাতের সঙ্গে আলু পুড়া (আলু ভর্তা), পানি ভাত খাইয়া দিন যাইতেছে কোনভাবে।
উপজেলার উজান তাঁতীপুরের রোকেয়া বেগম বলেন, ঘুম থাকি উইঠ্যা খাওয়ার চিন্তা করি। দুটা মাইয়্যারে লেখাপড়া করাইতে পারতেছিনা, অসুখ লেগে আছে। দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটতাছে আমাদের।
রামজীবনপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী হাওরে মাছ ধরছিলেন আলমগীর মিয়া। তিনি বলেন, হাওরে মাছ ধরে যা টাকা পাই তা দিয়ে চাল কিনতে হয়। আমাদের হাওর এলাকায় সবজিও কিনতে পাওয়া যায় না। একমাত্র সবজি বলতে আলুই ভরসা। এছাড়া চাল কেনার পর মাংস, মাছ, উপজেলা সদর থেকে সবজি কেনার মত টাকা হাতে থাকে না।
হাবিবুর রহমান নামের আরেক জেলে বলেন, হাওরের মানুষের চেহারায় এখন অভাবের ছাপ পড়েছে, ঘরে ঘরে অভাব। অনেকেই তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছেন। যে সরকারি সাহায্য দেয়া হয় তা দিয়ে এক সপ্তাহও যায় না আমাদের।
একই এলাকার আমিরুন নেছা বলেন, আমার স্বামী মারা গেছে, আমি মহাবিপদে, রোজগারের মানুষও নাই ঘরে। আমরা বাঁচতাম চাই, সরকার আমাদের সাহায্য দেওক, আমরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাঁচতে চাই।
জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে এবার ১৫৪টি হাওরে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জেলার ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯০ কৃষক পরিবার। তবে স্থানীয় কৃষক-জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, হাওরের ৯০ শতাংশ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে বাঁধ ভেঙে জেলার সবক’টি হাওরের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। সাধারণ কৃষক পরিবারগুলো খুব কষ্টে আছে। আমাদের দাবি, পরবর্তী ফসল ঘরে উঠা না পর্যন্ত সুনামগঞ্জের হাওরে মাছ ধরা উন্মুক্ত করে দেয়া হোক। যাতে অসহায় হাজার হাজার মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই হাওর ডুবির কারণে কৃষক বিপর্যস্ত। সব হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। সরকারিভাবে যে সাহায্য দেয়া হচ্ছে তা অপ্রতুল। তার মধ্যে আবার সরকারি বিশেষ প্রণোদনাও বন্ধের পথে। হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বাঁচাতে আগামী ফসল ঘরে না উঠা পর্যন্ত সরকারি প্রণোদনাগুলো চালু রাখা প্রয়োজন।