খুব সম্ভবত ১৯৯৬ সালের দিকে সুনামগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীন মহল্লাভিত্তিক বিভিন্ন সভায় এলাকার সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তার সমাধানকল্পে বাসিন্দাদের সাথে মতবিনিময় করেন। চিহ্নিত সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগের অভাব বিষয়টি তার কাছে প্রাধান্য পায় এবং এলাকাবাসী জায়গার ব্যবস্থা করে দিলে পৌরসভা সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। এলাকাবাসী তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিদ্যালয়ের জন্য জায়গার ব্যবস্থা করে দেন। পৌরসভা নিজস্ব অর্থায়নে বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণ, প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম সংগ্রহ, শিক্ষক নিয়োগসহ যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্নপূর্বক আমার যদ্দূর মনে পড়ে ১৯৯৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু বিদ্যালয়গুলো সরকারি নিবন্ধনের (রেজিস্ট্রেশন)-এর জন্য কোন পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেননি।
যে সকল এলাকায় বিদ্যালয়গুলো স্থাপন করা হয়, তা অতিশয় দারিদ্রপ্রবণ, রিকশা বা টেম্পোতে করে বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের দূরবর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যয় বহন করার সামর্থ্য অধিকাংশ অভিভাবকের নেই। তাছাড়া বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের একা বিদ্যালয়ে প্রেরণে নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত, যা যে কোন অভিভাবকের উদ্বেগের বিষয়। সবদিক বিবেচনায় পৌরসভার এ মহতী উদ্যোগটি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। সংশ্লিষ্ট এলাকার দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থানকারী, এমনকি অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারেরও শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত শিশুরা উদ্যম-উল্লাসের সাথে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া, পাঠগ্রহণ শুরু করে। একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক-শিক্ষিকা যৎসামান্য সম্মানীর বিনিময়ে পাঠদান শুরু করেন, যা দিয়ে তাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার খরচও সংকুলান হয় না। তারা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। এছাড়াও বিদ্যালয়ের মান উন্নয়ন ও সংহত করার লক্ষ্যে প্রতিটি সমাপনী ও বার্ষিক পরীক্ষার আগের তিন-চার মাস বিনাপারিশ্রমিকে ছাত্রছাত্রীদের নিজ বাসায় এনে তারা বিশেষ পাঠদান করে আসছেন, যে ‘বিশেষ পাঠদান’র বিশেষ বাণিজ্যের সুযোগ আজ-কাল উচ্চ বেতনভুক্ত সরকারি শিক্ষক-শিক্ষিকাগণও সহজে হাতছাড়া করতে চান না।
আমি নিজে দীর্ঘদিন যাবৎ সমাজ সচেতনতা সৃষ্টি ও উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের সাথে জড়িত থাকায় এবং আমার স্ত্রী পৌরসভা পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। আমি দেখছি চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে থেকেও কোনপ্রকার অনুদান, প্রশিক্ষণ ছাড়াই পৌরসভার সীমিত সহায়তা দিয়ে নিজেদের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে কিভাবে শিক্ষক-অভিভাবকদের পারস্পরিক সহযোগিতায় বিদ্যালয়গুলোকে তিলে-তিলে গড়ে তুলছেন। আজ বিদ্যালয়গুলো সম্মানজনক একটা অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। বিগত কয়েক বছরের সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল এর নীরব সাক্ষী।
বিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণরূপে সরকারি কারিক্যুলাম অনুযায়ী পরিচলিত হচ্ছে। শিক্ষাবিভাগ প্রতিবছর বিদ্যালয়সমূহ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিচ্ছে, ছাত্র-ছাত্রীরা বিনামূল্যে বই পাচ্ছে, সরকারি রুটিনমাফিক বিভিন্ন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে অর্থাৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষাবিভাগের মধ্যে যে কার্যক্রম চলে তার প্রায় সবগুলোই পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে বিদ্যমান। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই, বিদ্যালয়গুলোকে পাঠদান উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য সরকারি কোন উদ্যোগ নেই।
বলা অযৌক্তিক হবেনা যে, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়ম-শৃংখলা অনুযায়ী পরিচালিত হতে বাধ্য, কিন্তু সরকার সকলের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি বরতে বাধ্য নয়। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি কিন্তু এহেন বৈষম্যের কথা বলেনা। সেখানে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সকলের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টির কথা রয়েছে।
শিক্ষানীতির কর্মসূচি বাস্তবায়ন কৌশলে বলা হয়েছে, “প্রাথমিক শিক্ষা হবে সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সকলের জন্য একই মানের। মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য জাতিসত্তা, আর্থ-সামাজিক, শারীরিক, মানসিক, সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগোলিক অবস্থা নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করাই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
এর পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে এবং ইতোপূর্বে দেশের নিবন্ধিত, অনিবন্ধিত, পাঠদান অনুমোদিত, অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়সহ প্রায় ২৬০০০ বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। কিন্তু পৌরসভা পরিচালিত কয়েকটি বিদ্যালয় এর আওতায় পড়েনি। আইনের যে কোন ফাঁক-ফোকড়ের ঊর্ধ্বে থেকেই পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের অন্তর্ভুক্ত হতে পারত। কারণ, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান-বিশ্বাস মতে, পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোও এনজিও ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে। তাছাড়া স্থানীয় সরকার জাতীয় সরকারেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, সে বিবেচনায় এগুলো অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। পৌরসভা এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিগণের সদিচ্ছা থাকলে এখনও এগুলোকে জাতীয়করণের পর্যায়ভুক্ত করা সম্ভব। আমাদের মনে-মগজে ধারণা স্থিরিকৃত হয়ে আছে যে, এনজিও মানেই দেশ-বিদেশের আর্থিক অনুদানে কার্যকরী প্রতিষ্ঠান। প্রকৃত অর্থে সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচলনা বহির্ভূত এবং আইনানুগ স্বশাসিত, স্বায়ত্বশাসিত, স্বেচ্ছাসেবী সকল প্রতিষ্ঠানই নন গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশান বা এনজিও। সে অর্থে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানও সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্বশাসিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
আমি নিজে ঘুরে দেখেছি এবং ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবকদের কারো-কারো সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি যে, পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন। যেমন (১) দু/একটি বিদ্যালয়ের টিনের ছাউনি ফুটো হয়ে গেছে, সামান্য বৃষ্টি হলেই পাঠদান ও পাঠগ্রহণ ভয়ানক বিঘিœত হয়। (২) উপরে সিলিং এবং ফ্যান না থাকায় গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রৌদ্রতাপে শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষদের অবস্থান ক্রমেই দুঃসহ যন্ত্রণাময় হয়ে উঠছে। (৩) নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। (৪) বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষার মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব। (৫) মনিটরিংয়ের অভাবসহ বিবিধ সমস্যাজর্জরিত পৌর-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। ফলশ্রুতিতে অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যৎসামান্য সম্মানীও অনিয়মিত। কিছুদিন ধরে তা বন্ধ হয়ে আছে। পৌরসভার তহবিল সংকটের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে তারা মনে করেন। এ বিষয়ে সম্মানীয় মেয়র শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে তাদের উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতে পারেন। কারণ তিনি তাদের আইনানুগ অভিভাবক ও দিকনির্দেশক। এক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বলেই আমি বিশ্বাস করি।
শোনা যাচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পরীক্ষা নেয়া হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া প্রায় ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠনিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ মুহূর্তে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পদোন্নতির কোন সুযোগ পৌর বিদ্যালয়ে আছে বলে মনে হয় না। তবে তাদের দক্ষতা ও মান উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যাপারে শিক্ষা বিভাগের সহায়তা নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। শিক্ষানীতির শিক্ষাক্রম কৌশলে বলা হয়েছে, “শিশুর সৃজনশীল চিন্তা ও দক্ষতার প্রসারের জন্য সক্রিয় শিক্ষন পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীকে এককভাবে বা দলগতভাবে কার্যসম্পাদনের সুযোগ দেয়া হবে।” সুতরাং, এখানে সেবাদানকারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সহজেই বোধগম্য। কুড়িটি বছর ধরে যাদের মেধা-শ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে গড়ে তোলা অনেক ছাত্রছাত্রী আজ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এহেন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের অধোগতি বা ভেঙ্গে পড়া এর কারিগরদের গভীর উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তায় দিনযাপন, অধ্যয়নরত কোমলমতি শিশুদের জীবনে এর ক্ষতিকর প্রভাব, কোনটাই কোন শিক্ষানুরাগী চাইবেন না। মেয়র মহোদয়- আপনিও নিশ্চয়ই, তা চান না?