1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

জঙ্গদাশের ভিটা ও লালুর গোয়ালা বাঁধ ভেঙে ডুবছে শনির হাওর : ২৪ দিন যুদ্ধ করে হেরে গেলেন কৃষক

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭

শামস শামীম, শনির হাওর ঘুরে এসে ::
রোববার দুপুর ২টা। আকাশে লুকোচুরি খেলছে মেঘ। তাহিরপুরের শনির হাওর পার্শ্ববর্তী গ্রাম সাহেব নগরের পাশের জঙ্গ দাশের ভিটা ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে সো সো শব্দে পানি ঢুকছে হাওরে। বাঁধের উত্তর পাশে গালে হাত দিয়ে বসেছেন ষাটোর্ধ্ব কৃষক মো. বুরহান উদ্দিন। যেখানে বাঁধ ভেঙেছে সেখানের গোড়াটায়ই ছিল তার ফসল জমি। সকালে সবার আগে তিনি বাঁধে এসে দেখেন বুরুঙ্গা (ছিদ্র) দিয়ে পানি ঢুকছে।
নিজের ফসলের মায়ায় কয়েকটি বস্তা ফেলেন তিনি। বস্তা ফেলার সাথে সাথেই ¯্রােতের প্রবল বেগে উড়ে যায় সে বস্তা। এভাবে প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেননি। এই সময়ে ২ হাত দৈর্ঘ্যরে ভাঙ্গা থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ২০ হাত দৈর্ঘ্য হয়ে যায় জঙ্গ দাশের ভিটা বাঁধ। বিকেল ৪টা পর্যন্ত বুরহান উদ্দিন চেয়ে চেয়ে দেখেছেন ফসলের ডুবে যাওয়ার করুণ দৃশ্য। ডুবে যাওয়ার মিছিলে এই হাওরটিই ছিল শেষ হাওর। হাওরটিকে প্রায় ২৪ দিন ধরে যুদ্ধ করে টিকিয়ে রেখেছিলেন কৃষক। গতবারও এই হাওরটি সবার আগে ডুবে গিয়েছিল। এবার ডুবল সবার শেষে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা বেষ্টিত শনির হাওরটিতে এ বছর প্রায় ৮ হাজার ২৯৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছিল। এই হাওরে বাধের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৫২ কি.মি.। তবে হাওরে কৃষি বিভাগের মতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল। ৩শ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হওয়ার কথা। রোববার সকালে লালুর গোয়ালা বাঁধ ও জঙ্গ দাশের ভিটা বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকতে থাকে। সারা দিনে দুই ভাঙ্গন দিয়ে হাওরের দুই তৃতীয়াংশ বাঁধ ভেঙে হাওরের আধা পাকা ফসল তলিয়ে যায়।
বুরহান উদ্দিন বলেন, ‘সকাল ৭টায় আইয়া দেখি দুই আত ভাঙ্গা। ইটা মারি বস্তা ফালাই আউরে। বস্তা লইয়া যাত ফোত। বারবার দেই বার নেয়। বাইন্দা রাখতাম পারছিনা। তিনি জানান, ভাঙ্গা বাঁধের নিচেই ছিল তার সাড়ে তিন একর জমি। সবুজের খোলস ছেড়ে ধান হলুদের রঙ নিতে শুরু করেছিল। এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। গতবার আর এবারের দেনা দাঁড়িয়েছে তার প্রায় দুই লক্ষ টাকা। কি খাবেন আর দেনাদারদের কি দেবেন তা ভেবে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
তার পাশেই আহাজারি করছিলেন একই গ্রামের কৃষক শিহাব কামাল। তারও এই হাওরে ছিল ৩ একর জমি। সকাল থেকেই সেই জমি চোখের সামনে ধীরে ধীরে তলাতে দেখে নির্বাক হয়ে গেছেন তিনি। এই সময় এই বাঁধে দেখা গেল ছোটাছুটি করছেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল। যিনি গত ৩১ মার্চ থেকে টানা রাতদিন বাঁধে অবস্থান করে কাজ করেছেন। তিনিও এখান থেকে ওখানে ছুটোছুটি করেন। আর কৃষকদের সান্ত¦না দেন। তাকেও দেখা গেল কাচা ধানের পাড়ায় (স্তূপে) হেলান দিয়ে করুণ চোখে ডুবে যাওয়া হাওর দেখতে।
এই বাঁধের ঠিক আধা কি.মি. দূরেই ছিল লালুর গোয়ালা বাঁধ। এই বাঁধটিও একই সময়ে ভেঙ্গে সো সো শব্দে ভীষণ বেগে পানি ঢুকছিল। বাঁধের নিচের অংশে দেখা গেল কৃষকরা জাল নিয়ে মাছ ধরতে নেমেছেন। কারণ এই হাওরটি এতদিন টিকে যাওয়ায় পানিদূষণ হয়নি। তাই ফসল হারা কৃষক বাঁচার তাগিদে মাছ ধরতে নেমেছেন। প্রবল বেগে ¯্রােত যাওয়ায় মাছের উজার নেমেছে ওখানে।
দুপুর ১টায় শনির হাওরপাড়ের গ্রাম মধ্য তাহিরপুরের দক্ষিণে হাওরের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কৃষক বিনয় রায়। তিনি বলেন, দুই একর জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। রবিবার সকাল থেকেই ধান তলাতে শুরু করে। দুপুরের মধ্যেই অর্ধেক জমি তলিয়ে যায়। আধাপাকা ধান কাটার ইচ্ছে থাকলেও শ্রমিকের অভাবে কাটতে পারিনি।
তার পিছনেই শতচ্ছিন্ন জামা গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রমিক অনীল দাস। পরের জমি কেটে ভাগে যা পান তা দিয়েই সংসার চালান। অনীল দাস বলেন, ‘পরের জমিত খাইট্টা খাই। ইবারতো খাওয়ার উপায় নাই। সব শ্যাষ অইয়া গেছে। কিলা বাচতাম ভাই’।
তার পেছনেই হাতে কাচি নিয়ে ভাগে কাচাধান কাটতে বিন্নাকুলি গ্রাম থেকে এসেছেন শ্রমিক রুবেল ও একাদুল মিয়া। তারা জানালেন, ৬ মুঠি ধান কাটলে একমুঠো ভাগে পান তারা। গত শনিবার থেকে এভাবেই কৃষকের আধপাকা ধান কাটছেন। তবে পানি ঢুকে পড়ায় আজ (রোববার) কাটতে পারলেও কাল থেকে (সোমবার) আর পারবেন না। তারা প্রতি বছরই এভাবে ভাগে ধান কেটে আহার সংগ্রহ করেন বলে জানান। এদের পিছনে হা-হুতাশ করছিলেন কৃষক কাঞ্চু দাশ। তার চোখে মুখে বেদনার অভিব্যক্তি। যাকেই পাচ্ছেন তাকেই বলছেন আমার ‘সব জমিন তল অইগেছে’। এভাবেই অনেক কৃষককে দেখা গেল হাওরের কান্দা-জাঙ্গাল ও ভাঙ্গা বাঁধের কিনারে দাঁড়িয়ে বিলাপ করতে। সবাই সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুলের আক্ষেপটা আরো করুণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিমান আর ক্ষোভের সুরে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘দেইখ্যো কালকে থাকি আকাশ ভালা অইজিব। শনির হাওর খাইলিছেতো। এখন আর মেঘ তুফানও আইতোনা। আমরারে মাইরা নিজে ডুবে মরছে এখন’। এমন যন্ত্রণার কথা শুধু কামরুলেরই নয় শত কৃষকের। যারা গত ৩১ মার্চ থেকে টানা হাওররক্ষায় যুদ্ধ করেছেন। ক্লান্তিহীন এই যোদ্ধারা কাজ করেও শেষ রক্ষা করতে না পারায় আক্ষেপটা তাদের রয়েই গেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, শনির হাওরের নিচের অংশ আরো আগেই আক্রান্ত হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ২০-২৫ ভাগ। সব মিলিয়ে ৮০-৯০ কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে। তবে দু-একদিন পরে পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণের চিত্র পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com