মো. আমিনুল ইসলাম ::
শহরের একটি নাটকের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা বলে হোটেলে কক্ষ ভাড়া নেয়া হয়। এক রাত হোটেলে অবস্থান করবেন বলে হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা হয়েছিল আগন্তুক যুবক-যুবতীর। তারা নিজেদেরকে নাট্যকর্মী পরিচয় দিয়েছিলেন। ঘড়িতে তখন সময় রাত ১১টা। কথা অনুযায়ী হোটেল রেজিস্ট্রারে পরিচয় লিপিবদ্ধ করা হয়- তাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী। এ পরিচয় নিয়ে রাতে হোটেলের নিচতলার একটি কক্ষ তাদেরকে ভাড়া দেয়া হয়। প্রতিদিনকার মতোই স্বাভাবিক নিয়মে হোটেলকর্মীরা তাদের নিজেদের কার্যক্রম গুছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সকাল হওয়ার সাথে সাথে তাদেরকে পরিচয় হতে হলো অন্য রকম এক পরিবেশের সাথে।
রাতে যাদেরকে ভাড়া দেয়া হয়েছিল তাদের কক্ষে তালা ঝুলছে। রাত কেটে যাওয়ার সাথে সাথে নাশতার কথা বলে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েটির স্বামী পরিচয়দানকারী যুবক। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও তিনি ফিরে না আসায় সন্দেহ ঘনিভূত হতে থাকে হোটেল কর্তৃপক্ষের। আর তাই দরজায় কড়া নাড়তে থাকেন তারা। অনেক ডাকাডাকির পরেও যখন ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না তখন পুলিশে খবর দেয়া হয়। আর এরপরই প্রকাশ হয় মূল ঘটনা। কক্ষটি থেকে উদ্ধার করা হয় স্ত্রী পরিচয়ে হোটেলে ওঠা মেয়েটির মরদেহ।
গতকাল শুক্রবার সকালে শহরের পুরাতন বাসস্টেশন এলাকার ‘আল হেলাল ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি হোটেলে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নিহত মেয়েটির নাম চুমকি আক্তার (২২)। সে সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের নরুল্লা গ্রামের বাসিন্দা। তার পিতা মৃত হারুনুর রশীদ ও মা শাহেদা বেগম।
সদর মডেল থানা পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, গোলাপী ও হলুদ রঙের একটি ওড়না চুমকির গলায় পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়। পরে সাদা রঙের একটি চাদর দিয়ে চুমকির লাশ বিছানার উপর ঢেকে রাখে ঘাতক। হোটেল রেজিস্ট্রার অনুযায়ী যার নাম মো. মাহিন ইসলাম (২৭)।
বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় হোটেল ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন কামরুল হোসেন। তিনি হোটেলে আসা আগন্তুকদের পরিচয় জানতে চাইলে মাহিন ইসলাম নিজেকে চুমকির স্বামী পরিচয় দিয়ে একটি কক্ষ ভাড়া নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারা নিজেদেরকে নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রী পরিচয় দিয়ে সিলেট থেকে এসেছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। তারা হোটেল ম্যানেজারকে আরো জানান, সুনামগঞ্জে তারা একটি নাটকের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন। মাহিন ইসলাম হোটেল রেজিস্ট্রারে তার পিতার নাম লিখিয়েছেন মৃত ফুল মিয়া। তার স্থায়ী বাসস্থান উল্লেখ করেছেন শহরের পশ্চিম তেঘরিয়া এলাকায়। পেশা সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহিন নিজেকে চাকরিজীবী বলে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, কক্ষ ভাড়া দেয়ার সময় হোটেল কর্তৃপক্ষ আগন্তুক যুবক-যুবতীর কোন ছবি তোলে রাখেনি। পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়নি ভোটার আইডিকার্ডের কোনো নম্বর। পরিবর্তে ভোটার আইডি নম্বরের স্থলে লিখে রাখা হয়েছিল স্বামী পরিচয়দানকারী মাহিন ইসলামের ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বর।
হোটেলের নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী তাদেরকে নিচতলার ১০১ নম্বর সিঙ্গেল একটি রুমে থাকতে দেয়া হয়েছিল। মাহিন ইসলাম ও চুমকি আক্তারের সাথে কোন ব্যাগ বা জিনিসপত্রও ছিল না। রাতে কোন শোর-চিৎকারও শোনতে পাননি হোটেলকর্মীরা। সকাল হওয়ার পর নাশতা আনার কথা বলে কক্ষের দরজায় তালা দিয়ে মাহিন ইসলাম কৌশলে হোটেল থেকে বেরিয়ে যায়। পরে প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সে ফিরে না আসায় কক্ষটির দরজার সামনে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করেন হোটেলকর্মীরা। এসময় ভেতর থেকে কোন আওয়াজ না পেয়ে তারা পুলিশে খবর দেন। তখন ঘড়িতে সময় সকাল সাড়ে ১০টা।
এসময় সদর মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে হোটেলে থাকা বিকল্প চাবি দিয়ে খোলা হয় দরজাটি। এসময় বিছানার উপর চুমকির লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ।
জানা যায়, গত বছরের এপ্রিল-মার্চ মাসের দিকে সদর মডেল থানায় একটি নারী নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করে চুমকি। ঐ অভিযোগে মাহিন ইসলামকে আসামি করা হয়। অভিযোগে চুমকি ও মাহিন ইসলামের প্রেমের সম্পর্ক বিষয়ে বিরোধ প্রকাশ পায়। পরে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি নিষ্পতি করে তাদেরকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। পুলিশের ধারণা মাহিন ইসলাম চুমকি ছাড়াও একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মাহিন ইসলাম অতীতে সুনামগঞ্জ শহরের একটি বিস্কুট কোম্পানির ডিলারের দোকানে কাজ করতো। শহরের ওয়েজখালি এলাকায় সে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতো। পরে সে অন্যত্র চলে যায়। বৃহস্পতিবার রাতে মাহিন ওয়েজখালি এলাকায়ও গিয়েছিল।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদেরকে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হোটেল থেকে খবর দেয়ামাত্র আমি, অফিসার ও আমাদের পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছি। সেখানে গিয়ে দরজা খুলে মেয়েটির লাশ উদ্ধার করা হয়। মেয়েটিকে ওড়না দিয়ে পেচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। আমরা লাশটি উদ্ধার করে হাসপাতাল মর্গে পাঠাই। বর্তমানে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে এবং পলাতক মাহিন ইসলামকে গ্রেফতারের চেষ্টা ও মামলার প্রস্তুতি চলছে।’