মো. আমিনুল ইসলাম ::
মাইকের উচ্চ শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর কারণে ব্যাহত হচ্ছে তাঁদের পড়াশোনা। সকাল, দুপুর কী বিকেল; মাইকিং চলছেই। কখনো রিকশায় করে, কখনোবা সিএনজি চালিত অটোরিকশায় করে উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো হচ্ছে। পণ্যসামগ্রী, দোকান উদ্বোধন, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রচারণায় শহরে উচ্চ শব্দে মাইকিংয়ের ফলে শিক্ষার্থী ছাড়াও সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়ছেন।
প্রতিদিন সকালে বিদ্যালয়ের পাঠ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে বিকেলে স্কুল ছুটি হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার মাইকিং যন্ত্রণার কারণে ভোগান্তির শিকার হন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। উচ্চ শব্দের কারণে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠ কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রাখতে হয়।
গতকাল মঙ্গলবার শহরের হোসেন বখত চত্বর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশ দিয়ে উচ্চ শব্দে রিকশায় করে মাইক বাজানো হচ্ছে। স্থানীয়রা জানালেন, এ চিত্র প্রতিদিনকার। অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অভিযোগ করে বলেন, প্রায় প্রতিদিনই সভা-সমিতি, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে ঘিরে প্রচারণা চালানো হয়।
জানা যায়, উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর কারণে শহরের এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, আদর্শ শিশু শিক্ষা নিকেতন, সৃজন বিদ্যাপীঠ, শহর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, কালীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ শহরের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। তারা এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে কথা হয় শহর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সঙ্গে। উচ্চ শব্দে মাইকিংয়ের কারণে ক্লাস চলাকালে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী নাহিয়ান ফাইজা অমি, পূজা মনি সরকার ও রাহেনা আক্তার ঊর্মি জানান, ক্লাস চলাকালে মাইকের উচ্চ শব্দ তাদের পাঠের মনোযোগ নষ্ট করে। নাহিয়া ফাইজা অমি বলেন, ‘আমরা মাইকের শব্দের জন্য ক্লাস করতে পারি না। যখন মাইকের শব্দে কানে ব্যথা হয় তখন আমরা ক্লাসের সবাই দুই হাতের আঙুল গিয়ে কান বন্ধ করে রাখি। কিছু সময় পরে মাইক চলে গেলে আমরা আবার ক্লাস শুরু করি। হঠাৎ করে একটার পরে একটা মাইক নিয়ে রিকশা আসে। মাইকের শব্দ ছাড়া আর কিচ্ছু শোনা যায় না। আমাদের ক্লাস করতে খুব সমস্যা হয়।’
কালীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ত্রিপর্ণা রায় তিথি ও প্রমি তালুকদার জানান, মাইকের উচ্চ শব্দের কারণে তাদের ক্লাস করতে সমস্যা হয়। মাইকিং তো আছেই তার উপর তাদের স্কুলটা সড়ক সংলগ্ন হওয়ায় যানবাহনের অতিমাত্রার হর্ন তাদের পাঠকার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ত্রিপর্ণা রায় তিথি বলেন, ‘আমরা স্কুলে আসলে গাড়ির হর্নের জন্য ক্লাস করতে পারি না। আর ভর্তি হওয়ার পর থেকে আজ কয়েক বছর ধরে একই অবস্থা দেখছি। সেটা হলো মাইকিং। এতো জোরে জোরে শব্দ হয় যে, আমরা ম্যাডামের কথা কিছুই শুনতে পাই না। এ সময় ক্লাসের সাময়িক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। মাইকবাহী রিকশা দূরে যাওয়ার পর পুনরায় পাঠদান শুরু হয়। আমাদের স্কুলের গেইটের সামনে রিকশা থামিয়ে মাইকওয়ালারা উচ্চ শব্দে মাইক বাজাতে থাকে।’
সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ফৌজিয়া সিদ্দিকা মাইশা। তিনিও মাইকের উচ্চ শব্দে অতিষ্ঠ। মাইশা বলেন, ‘আমরা যখন ক্লাসে রিডিং পড়ি তখন সড়ক দিয়ে মাইক আসলে আমরা নিজেদের পড়াই নিজেরা শুনি না। ক্লাসে মারাত্মক রকমের সমস্যা হয়। আমরা এ সমস্যায় নিয়মিত ভুগছি। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানের কোন উপায় দেখছি না। স্কুলের সামনে মাইক বাজানোটা বন্ধ করা উচিত।’
এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী মারিয়া আলম, তাসনিম হুমায়রা ও তাসফিয়া আনজুম জানান, স্কুল চলাকালীন মাইকের উচ্চ শব্দের কারণে পাঠগ্রহণে তাঁদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ ব্যাপারে বেশ কয়েকবার তারা বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা পরিষদকে অবগত করেছেন।
তাসনিম হুমায়রা বলেন, ‘আমরা এই মহাসমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি নিয়মিতই। পাঠদান কার্যক্রমের সময় উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে সভা-সমাবেশ, ডাক্তারের চেম্বার, অমুক ভাইকে শুভেচ্ছা, তমুক সাহেবের সংবর্ধনা ইত্যাদি মাইকিং যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। এতো শব্দ সৃষ্টি করে মাইক বাজানোটা শব্দ দূষণ, বিশেষ করে মাইকওয়ালারা স্কুল-হাসপাতাল কিছুই মানে না, এতে শিক্ষার্থী ও রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নিয়মিত’।
এদিকে, শিক্ষার্থী ছাড়াও মাইকিংয়ের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষকরাও। শহর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা সাবিয়া সুলতানা বলেন, ‘মাইকিংয়ের জন্য আমরা ঠিকমতো ক্লাস তো দূরের কথা পরীক্ষাও নিতে সমস্যা হয়। এরা পরীক্ষা কেন্দ্রও মানে না, বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে মাইক চালিয়ে যায়। শব্দ দূষণ করে। এটা নিয়মিত ঘটনাই। এ সমস্যা সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।’
কালীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নমিতা রাণী সরকার বলেন, ‘উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর কারণে আমরা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। এরা স্কুলের সমানে দাঁড়িয়ে মাইক বাজায়। গাড়িগুলোও উচ্চশব্দে হর্ন বাজায়, বাচ্চাদের খুব সমস্যা হয়।’
সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাসিমা রহমান বলেন, ‘উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর কারণে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। মাইক বাজানো সময় আমাদের সাময়িক পাঠদান বন্ধ রাখতে হয়। এতে ক্লাসের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। আমি এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনকেও অবগত করেছিলাম। এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।’
সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রহিম বলেন, ‘পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে এবং ক্লাসের সময় মাইকের শব্দে ছাত্রীদের সমস্যা হয়। আমরা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম। অন্তত ক্লাস চলাকালীন সময়ে যেনো বিদ্যালয় এলাকায় মাইক না বাজানো হয় এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্লাস চলাকালীন সময়ে উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো একেবারেই নিষিদ্ধ। এসময় জরুরি প্রয়োজনীয় সরকারি কোনো ঘোষণা মাইকে প্রচার করা যাবে। এছাড়া মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা যাবে। এর বাইরে সভা-সেমিনার বা রাজনৈতিক কোন বিষয় নিয়ে কোন ধরনের মাইকিং করা যাবে না। স্কুলের সময় শেষ হলে ওই সময় থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মাইকে তথ্য প্রচার করা যাবে। অন্যথায় কোনভাবেই বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় মাইকিং করা যাবে না। আমরা প্রশাসনিকভাবে এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। আমরা দেখামাত্রই এসব মাইক আটক করছি।