চারিদিকে জীবনানন্দীয় ‘অদ্ভুত আঁধার’ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। জীবন ও জগৎকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। সংস্কৃতির আলো বিকিরণের উৎস জগতের খোলা চোখের সামনে অপসংস্কৃতির চাদরে ঢেকে পড়া বেড়েই চলছে। পত্রিকায় পড়তে হচ্ছে “ইরাকে ৫০টির বেশি গণকবরের সন্ধান”। আর বাংলাদেশে প্রগতিশীলতার শিখা নিভু নিভু। এখানে উত্থান ঘটেছে ভোগবাদী নগর সংস্কৃতির। বেড়েছে ভোগের ক্ষমতা ও চাহিদা, কমেছে সৃজনশীলতা ও প্রকৃত আধ্যাত্মিক চেতনার দীপ্তি, আতঙ্কের বিস্তার বিশাল বপুত্ব ও প্রগাঢ়তা পেয়েছে। ক্রমে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ। ‘ক্রমে আলো আসিতেছে’ কমলকুমার মজুমদারের সেই বাক্য পাল্টে গিয়ে হয়ে গেছে ‘ক্রমে আঁধার আসিতেছে’। ভোগবাদিতার সঙ্গে সাড়ম্বর ধর্মচর্চার আঁধারে প্রতারণা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণসহ সমস্ত রকম মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়ে চলেছে নির্বিঘেœ ও অপ্রতিরোধ্য অনিবার্যতায়। শোষণ শাসনের নাগপাশ আরও সুদৃঢ় হচ্ছে, বাড়ছে পুঁজি বাড়ছে মুনাফা। তখন রবীন্দ্রনাথের ১৫৫তম জয়ন্তী পালন করছে আক্রান্ত বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৮-’৬৯-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের সকল প্রগতিশীলতা ও বাঁচা-বাড়ার সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ বাঙালিসহ সহযোদ্ধা অন্য জাতিসত্ত্বার সঙ্গে ছিলেনÑ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গান গাইতে গাইতে। পাকিস্তানি আমলে তাঁকে নিষিদ্ধ করে দমিয়ে রাখা যায়নি। তিনি আরও প্রবল হয়েছেন, বেড়েছে তাঁর প্রতাপ, তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালি তথা বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতির প্রাণভ্রমরা। রবীন্দ্রনাথ এভাবেই প্রতিবাদী, এভাবেই বিদ্রোহী, এভাবেই বিপ্লবী।
বর্তমানে বাঙালিকে তথা বাংলাদেশকে স্বসংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে অপর সংস্কৃতির ধারক করে তোলে প্রকৃতপ্রস্তাবে জাতিগতভাবে নির্বীর্ষ করে দিতে চাইছে বিশ্বাঘাতক মীরজাফরের উত্তরাধিকারীগণ। তারা সংস্কৃতির উপর আক্রমণ-অভিঘাত হানছে প্রতিনিয়ত। ইতোমধ্যে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে দেশে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সার্থক সাঙ্গাত নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত, বিষ্ণু দে, সুনীল, শক্তি, শঙ্খ, শামসুর এই আক্রমণ প্রতিহত করে এসেছে অতীতে, আজও প্রতিহত করবে। রবীন্দ্রনাথের জয় হবেই। রবীন্দ্রনাথের জয় মানে বঙ্গবন্ধুর জয়, বাংলার জয়, বাঙালির জয়। বাঙালির জয় মানে বাংলাদেশের বাঙালিসহ অন্য জাতিসত্ত্বার জয়। রবীন্দ্রনাথের জয় মানে বাংলাদেশের জয়, বাঙালি সংস্কৃতির জয়।