পুলক তালুকদার ::
গ্রীষ্মের প্রচন্ড উষ্ণতায় প্রাণি থেকে মানুষ সবাই হিমেল ছায়ার সন্ধানে ছুটে চলে। তপ্ত রোদ থেকে নিষ্কৃতি পেতে পাখিরা আশ্রয় নেয় গাছের ডালে পত্রপল্লবের ছায়ায়। গরমের কাছে সবাই কাবু হয়ে যখন প্রশান্তির ছায়ায় আশ্রয় খুঁজে তখন শ্রমজীবী মানুষগুলো এতটুকু পর্যন্ত আশ্রয় নিতে পারেন না। গ্রীষ্ম পেরিয়ে যখন শীত আসে, কনকনে শীতের সকালে কম্বল কাঁথা-মুড়ি দিয়ে আবদ্ধ ঘরে আরামের সবাই উষ্ণতা খুঁজে। আমাদের দেশের মেহনতি কৃষক শ্রমিকেরা কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে লাঙল-জোয়াল, কাঁধে নিয়ে তারা ফসল বুনতে মাঠে চলে আসে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এবং শরীরের রক্তকে পানিতে পরিণত করে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই মেহনতি মানুষের প্রতীক হয়ে আছে মহান মে দিবস। শ্রমিকরা যখন নানা বৈষম্য ও নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার, তখন তাঁরা জানতো না ওই বৈষম্য ও নির্যাতন কীভাবে বেরিয়ে আসবে। প্রথমেই তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ১৮৬০ সালে রাস্তায় নেমে আসে শ্রমিক সমাজ। তখনও শ্রমজীবী মানুষেরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারেনি।
১৮৮১ সালে শ্রমিকরা আবার তাদের জোরালোভাবে দাবি তোলে ধরে। ন্যায্য অধিকার ও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমেরিকা ও কানাডায় দুটি শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়। তাদের এই ধারাবাহিক আন্দোলনে ১৯৮৪ সালে দু’দেশের শ্রমিক সংগঠন একটি প্রস্তাবনা পাশ করে। এতে বলা হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে শ্রমিকদের কর্মদিবস হবে ৮ ঘণ্টা। ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রমিক কাজ করবে না। শ্রমিকদের এই ঘোষণার পর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীদের মাথায় বাজ পড়ে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীরা শ্রমিকদের দাবি মানতে নারাজ। ১৮৮৬ সালের ১ মে শ্রমিক সংগঠন তাদের অধিকার আদায়ের শিকাগোর শহরে হে মার্কেটে সমাবেশের ডাক দেয়। সরকার ও মালিকপক্ষ এ আন্দোলনকে বানচাল করতে পুলিশ লেলিয়ে দেয়। এই সমাবেশে গুলি চালায় পুলিশ। এতে অনেক শ্রমিক নিহত হন। এদিকে শ্রমিক তাঁর শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও ন্যায্য অধিকার আদায় করবেই। শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে মার্কিন সরকার পরাজিত হয় এবং তাদের অধিকার মেনে নেয়। মে দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও মে দিবস পালন করা হয়।
লেভার ফোর্স এর সার্ভে অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি শ্রমিক। এদের মধ্যে এক চতুর্থাংশ নারী শ্রমিক। প্রতি বছরই আমাদের দেশে মে দিবস পালিত হয়। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নের অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মে দিবস আসে আর যায় শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন হয় না। আমাদের দেশের বড় উন্নয়নের অংশিদার হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। বিভিন্ন সেক্টরে, দেশে-বিদেশে শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রমেই এদেশের উন্নয়নের পথ প্রদর্শক। কিন্তু এদেশের শ্রমিকরাই আজ অধিকার থেকে বঞ্চিত। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সরকার এবং মালিকগোষ্ঠীরা মারাত্মক ফাটল ধরা ভবনে শ্রমিকদের জোর করে ঢুকিয়ে কাজ করতে বাধ্য করে। যার ফলশ্রুতিতে ভবন ধ্বসে বিধস্ত হয়ে যায়। শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
পুঁজিবাদী ও শাসকগোষ্ঠীদের কাছে শ্রমিকের কোন মূল্য নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালন হলেও ছুটির দিন ঘোষণা হয়নি। শিল্পের শ্রমিকদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। তাদের সঠিক বেতন ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া, মালিকগোষ্ঠীরা দিতে পারে না। আমাদের দেশে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষক। তাঁরা সারের জন্য, সেচের পানির জন্য, বিদ্যুতের জন্য জমি চাষাবাদ করতে পারে না। খরা, বন্যা, শিলাবৃষ্টির মোকাবেলা করতে হয়। কৃষক ফসল উৎপাদন করতে টাকা খরচ করে তাদের লোকসানে বিক্রি করতে হয়। আমাদের দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যে শিশুটির কথা ছিল মা-বাবার ¯েœহ ও ভালোবাসায় বড় হয়ে খাতা, কলম হাতে নিয়ে বিদ্যালয়ে যাবে। এই কোমল শিশুরা এখন কলকারখানায় কাজ করছে। তাদের হাতে ঝুলছে ভারী যন্ত্র। সকালে ঘুম থেকে ওঠে কাজের সন্ধানে বের হয়ে রাতে ফিরে আসে।
আমাদের দেশের ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৭০০ কোটি আয় হয় তৈরি পোশাক শিল্পে। অথচ শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। তাদের বেতন বাড়ানো হয়নি। অথচ সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়িয়ে দ্বিগুন করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়নি। নেই পর্যাপ্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। একজন শ্রমিক বর্তমানে যে টাকা উপার্জন করেন সে টাকা দিয়ে পরিবারের খরচ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাড়ি ভাড়া দেয়া সম্ভব নয়। আমরা চাই বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করা হোক, তাদের ন্যায্য নাগরিক সুযোগ সুবিধা দেয়া হোক। পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী চেতনা সমাজ থেকে নির্মূল হোক। বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ হোক এবারের মে দিবসের অঙ্গীকার।