তারেক চৌধুরী ::
১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো ছাত্র সংগঠন সে সময় ছিল না। সে সময় মুসলিম ছাত্রলীগ নামে যে সংগঠন ছিল সেটি ছিল সাম্প্রদায়িক এবং আপোষকামী। শাসকগোষ্ঠী ভাষা আন্দোলনকে দমন করার জন্য যে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল, মুসলিম ছাত্রলীগ কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর এই গণবিরোধী নীতির পক্ষে অবস্থান নেয়। তাই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব বাস্তব কারণেই এদেশের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের হাতে চলে আসে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তে আমরা সেদিন শোধ করি মাতৃভাষা বাংলার ঋণ। ঐতিহাসিক এই সংগ্রামকে যথাযোগ্য পরিণতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন। তাই ভাষা সংগ্রামের সামনের কাতারের প্রগতিশীল ছাত্রনেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামকে যথাযথ মর্যাদার সাথে পরিচালিত করতে হলে অবশ্যই একটি অসাম্প্রদায়িক গণছাত্র সংগঠনের প্রয়োজন। তাই দেশভাগ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের উত্তরসূরি জাতি-ধর্ম-বর্ণ রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সকল ছাত্র সমাজকে প্রগতিশীল কর্মসূচি ভিত্তিতে একতাবদ্ধ করতে পারে এমন একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি এই চার মূল নীতিকে ভিত্তি করে ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ৫২’র গড়া সংগ্রামের অগ্নিশপথের মধ্যদিয়ে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। এরপর থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রত্যেক গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে রয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের রক্ত। শিক্ষা থেকে যদি শুরু করি তবে দেখা যায় পাকিস্তানি আমল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত যত সরকার এসেছে এবং তারা যে শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছে তা সবই ছিল বৈষম্যমূলক শিক্ষা সংকোচন ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারার। ১৯৬২ সালের আইয়ূব সরকারের শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর আইয়ূব সরকারের শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মোস্তফা, বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহ। তারপরও ছাত্র ইউনিয়ন এদেশের ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যায়। সেদিন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইয়ূব খান বাধ্য হয় এই গণবিরোধী বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাতিল করতে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যূথানের সংগ্রামে ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্র নেতা শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট আইয়ূব শাসনের পতন ঘটে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের অগ্রণী ভূমিকা। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাথে গড়ে তোলে দেশে সর্ববৃহৎ গেরিলা বাহিনী। ২০ হাজার সদস্যের এই গেরিলা বাহিনী হাটে-মাঠে-ঘাটে অপদস্ত করে তোলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আর তাদের দোসর আলবদর, রাজাকার, আল শামসদের। এছাড়াও সারাদেশের ১১টি সেক্টরের সাথে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অসংখ্য নেতাকর্মী। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় গেরিলা যুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন হয়ে উঠে দুর্বার। এমন এক সোনালী সময় ১১ নভেম্বর কুমিল্লার বেতিয়ারায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে হারিয়ে যান ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় নেতা নিজাম উদ্দিন আজাদ, সিরাজুল মনিরসহ ন্যাপ, কমিউনিস্ট, ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর ৮ সদস্য। ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীসহ সারা বাংলার অসংখ্য প্রাণ আর সাড়ে ৭ কোটি জনগণের ত্যাগের বিনিময়ে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্ম হয়। তবে তার স্বপ্ন সাধ বেশি দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারেনি। যে দূরন্ত স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল অল্প কিছুদিন পরেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর দুর্বলতায় ও স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানিপন্থীদের চক্রান্তে বিনষ্ট হয়ে গেলো লড়াই সংগ্রামে অর্জিত স্বাধীনতার লাল সূর্য। তাই ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র সমাজের দায়িত্ব এখনও শেষ হয়ে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফিরিয়ে এনে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার লক্ষ্যে ছাত্র ইউনিয়ন এখনও পথ চলছে অবিরাম।
[লেখক : সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ]