শামস শামীম ::
সুনামগঞ্জের ৩৬ হাওরের প্রায় ৩০০ কি.মি. ফসলরক্ষা বাঁধের জন্য সরকার এবার পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করে ২৯ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ শুরু হয় ফেব্রুয়ারির শেষদিকে। প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ না হওয়া, তদারকির অভাব এবং দুর্নীতির কারণে বাঁধের কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে শুরু থেকেই। পিআইসি অধিকাংশ কাজ না করেই অফিসকে কমিশন দিয়ে দ্বিতীয় দফা বিল তুলে নেয়। অভিযোগ রয়েছে তৃতীয় দফা বিলের সময় তাঁরা বাঁধের কাজ ধরেছিল। ফলে বৃষ্টিতে, পাহাড়ি ঢলে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে এবার ফসলহানি ঘটেছে। একই অবস্থা ঠিকাদারদের বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও হয়েছে বলে কৃষকদের অভিযোগ। এদিকে পাউবোকে বাঁচাতে এখন কৃষি বিভাগ হাওরের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেখাচ্ছে বলে কৃষকও জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, শুরুতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকরা কাজ শুরু না হওয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের বারবার অবগত করেন। কিন্তু তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি পাউবো’র সংশ্লিষ্টরা। গত সোমবার তাহিরপুর উপজেলার অন্যতম বড় হাওর শনির হাওরের নান্টুখালি বাঁধ তদারকির অভাবে এবং নি¤œমানের কাজের কারণে ভেঙে হাওরের পুরো ফসল তলিয়ে গেছে বলে কৃষকদের অভিযোগ। এই বাঁধের কাজে অনিয়মের অভিযোগ শুরুর দিকে ওঠলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা তাতে সাড়া দেননি। ফলে আধাপাকা ধান নিয়ে গত মঙ্গলবার পুরো হাওরটি তলিয়ে যায়।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের অপেক্ষায় ছিলেন! বাঁধ ভেঙে গেলে তাদের নি¤œমানের পুকুরচুরির কাজ জায়েজ করতে সহজতর হয়। এতে কাজের নি¤œমানের প্রশ্ন উঠলেও বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে তারা পার পেয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের তদন্ত প্রতিবেদনে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে গেছে বলে কৌশলে প্রতিবেদন নিয়ে আসে তারা। এতে কাজ না করানোর বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। তাই প্রতি বছর কাজ না করিয়ে এভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অপেক্ষা করে পাউবোর লোকজন! এতে ঝুঁকির মুখে অরক্ষিত থাকে হাওরগুলো। ফলে ফি বছরই ফসলহানি হয়। হাওরের ফসলহানি নিয়ে প্রথমে কিছু প্রতিবাদ হলেও পরবর্তীতে আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যাওয়ায় পার পেয়ে যায় পাউবো’র লোকজন।
কৃষকদের অভিযোগ জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওর, মইয়ার হাওর, দিরাই উপজেলার চাপতির হাওর, বরাম হাওর, তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, সদর উপজেলার ঝাউয়ার হাওর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার এবার সবচেয়ে বেশি হাওর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে বলে কৃষকদের অভিযোগ। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ শিলাবৃষ্টিতে সদর উপজেলা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা, তাহিরপুর উপজেলা, জগন্নাথপুর উপজেলা, দিরাই উপজেলা এবং বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় অন্তত ২০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। ঝুঁকির মুখে আছে অরক্ষিত হাওরগুলোর বাকি ফসল।
এদিকে ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে বরাবরের মতো এবারও শুরু থেকেই লুকোচুরি করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। পাউবোকে বাঁচাতে তারা সরকারকে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেখাচ্ছে বলে কৃষকদের অভিযোগ। কৃষি বিভাগের সামনে ঝাউয়ার হাওরের সম্পূর্ণ কাঁচা ফসল তলিয়ে গেলেও এখনো এই বিষয়টি তাদের চোখেই পড়েনি। দেখার হাওর ও খরচার হাওরের নি¤œাঞ্চলের ধান পানিতে কাঁচা অবস্থায় তলিয়ে গেলেও সেটিও তারা চোখে দেখছেনা। চোখের সামনে গত সোমবার শনির হাওরের সম্পূর্ণ ফসল তলিয়ে গেছে। এই হাওরের ৯৫ ভাগ আধা পাকা ফসল নিয়ে নিমিষেই ডুবে যায় হাওরটি। কিন্তু তারা বলছে ক্ষয়-ক্ষতি কম হয়েছে। নলুয়ার হাওর এবং মইয়ার হাওরে বাঁধ ভেঙে এবং শিলায় অর্ধেকেরও বেশি ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হলেও কৃষি বিভাগ বলছে ক্ষতি হয়েছে আংশিক। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা করছে কৃষি বিভাগ। উপরের মহলকে খুশি রাখতে তারা ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে দেখায় বলে অভিযোগ জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।
অন্যদিকে ধান পাকা নিয়েও তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। তুলনামূলক দুর্গম এলাকা শাল্লা এবং ধর্মপাশা উপজেলায় গত দশদিন আগে ৪০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে বলে তারা জানায়। বাস্তবে এখন পর্যন্ত এসব উপজেলায় ৪০ভাগ ধান এখনো পাকেনি। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে নিতেই ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে এভাবে কৃষি বিভাগ লুকোচুরি করছে বলে কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ।
কৃষকরা জানান, ধান পাকার আগেই চৈত্রের শেষ সপ্তাহে এবং বৈশাখে প্রথম সপ্তাহে অধিকাংশ হাওরের নি¤œাঞ্চলের কাঁচা ধান বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ায় ধানকে হিসেবেই আনছেনা কৃষি বিভাগ। ধান যখন পাকতে শুরু করেছে তখন পড়েছে শিলা ও বাঁধ ভেঙে ফসলহানির মুখে।
কৃষি সংশ্লিষ্ট লোকজন জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর টেবিলে বসে প্রতি বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। মাঠের বাস্তবতার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। একইভাবে ক্ষতির চিত্র নিয়েও তারা ঘরে বসে মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে সরকারকে পাঠিয়ে থাকে। তাছাড়া পাউবো’র দুর্নীতির মাধ্যমে দায়সারা বাঁধের কাজকে বৈধতা দিতেই তারা ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেখায় বলে তাঁদের অভিযোগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে এ পর্যন্ত হাওর তলিয়ে প্রায় ১৬০০০ হেক্টর এবং শিলাবৃষ্টিতে আরো ৪০০০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে, শিলায় এবং ডোবরায় নষ্ট হয়েছে।
তাহিরপুরের কৃষক বাবরুল হাসান বলেন, আমি এই মওসুমে প্রায় কেয়ার জমিতে ধান রোপণ করেছিলাম। গত ৯ এপ্রিল শিলাবৃষ্টিতে আমার আধাপাকা ধানের এক তৃতীয়াংশ এবং গত মঙ্গলবার বাঁধ ভেঙে বাকি অবশিষ্ট ধান সম্পূর্ণই তলিয়ে গেছে। এবার জমিতে কাচিই লাগানোর সুযোগ পাইনি। আমার মতো শনির হাওরের সকল কৃষকেরই একই অবস্থা।
জগন্নাথপুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ বলেন, দশ দিন আগেই আমাদের জগন্নাথপুরের হাওরের অর্ধেক ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এবার বড়জোর ২০ ভাগ ধান তোলতে পেরেছেন কৃষক। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে চরম বেগ পেতে হবে কৃষকদের।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পিআইসি ও ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণে তাহিরপুরের শনির হাওরের সম্পূর্ণ ফসল তলিয়ে গেছে। এখন কৃষি বিভাগ পাউবোকে বাঁচাতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দেখাচ্ছে। আমি কৃষি বিভাগকে বলেছি শনির হাওরের কোন কৃষক হাওরের জমিতে কাচি লাগাতে পারেনি। তারা ক্ষতির রিপোর্ট নিয়ে লুকোচুরি করলে আন্দোলনন গড়ে তোলা হবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কথা ভেবে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাহেদুল হক বলেন, এ পর্যন্ত জেলায় প্রায় হাজার হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। ক্ষতির এই প্রতিবেদন আমরা সরকারকে পাঠিয়েছি। অন্যান্য ক্ষয়-ক্ষতির রিপোর্টও তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিনই ক্ষয়-ক্ষতির রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে বলে তিনি জানান।