।। তারেক চৌধুরী ।।
পৃথিবীতে ভূমিদাস প্রথা বিলোপ হওয়ার পর থেকে পণ্য অর্থনীতির ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটে। ক্ষুদে উৎপাদকরা এক সময়ে এই ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। ক্ষুদে উৎপাদকদের আশা ছিল যে, ভূমিদাস প্রথার বিলোপের মধ্য দিয়ে কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষের জীবনে সুখ আসবে। এতে সাধারণ জনগণের উৎপাদন ব্যবস্থা কায়েম হবে। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতি দিন দিন কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের লালিত আশাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সকল দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক এবং মেহনতি মানুষ পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির আওতায় এসে গেছে। যদি কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষেরা বাজার অর্থনীতির আওতায় এসে পড়ে তবে গোটা সমাজটাই পুঁজিবাদের দানবীয় কবলে এসে পড়ে; কারণ সমাজের সিংহভাগ মানুষ খেটে খাওয়া যারা দিন আনে দিন খায়। বাজারের শোষণ এদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। বাজার অর্থনীতির আগে ভূমিদাস ও সামন্তবাদী অর্থনীতি দিনমজুরের জন্য স্বর্গ ছিল, বাজার অর্থনীতি আসার ফলে তাদের সুখের স্বর্গ বিলীন হয়ে নরকে পরিণত হয়েছে। অবশেষে বাজার অর্থনীতি তাদের জীবনকে তীব্র ভাবে দুর্বিসহ করে তুলেছে। বাজার অর্থনীতির ফলে ক্ষুদে উৎপাদকের উৎপাদন ক্ষুদ্রই থেকে যাচ্ছে। কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, হস্তশিল্পী, জেলে সকলেই বাজারের অসম বিনিময়ের মাধ্যমে জমিজামা হাল হাতিয়ার হারিয়ে নিঃস্ব ভূমিহীন মুজুরির শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। বাজার অর্থনীতির কারণে দেখা যায় নিজে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রেতা হিসেবে কৃষক,জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার সবাই কোন ন্যায্য মূল্য পায়না ঠকে, এবং অপরের পণ্যের ক্রেতা হিসাবেও তারা ন্যায্য মূল্য ঠিক করতে পারেনা বরং সেক্ষেত্রেও ঠকে। মনীষী কাল মার্কসের মতে, ‘সব ধরণের পণ্যই গড়ে তাদের নিজ নিজ মূল্যে বা স্বাভাবিক দামে বিক্রয় হয়’। কিন্তু দেখা যায় একজন কৃষক যদি ১মণ ধান ৫০০/- (পাচঁশত) টাকা দিয়ে বিক্রি করেন একই ধানের মূল্য আবার বাজারে ৫৫০/- (পাঁচশ পঞ্চাশ) টাকা দেখা যায় কৃষক এখানে তার ন্যায্যের মূল্যের চেয়ে ৫০/- (পঞ্চাশ) টাকা ঠকলেন। একজন হস্তশিল্পী যখন নিজের হাতের তৈরি একটি পণ্য ৩০ টাকা দিয়ে বিক্রি করেন তবে দেখা যায় একই পণ্যের দাম বাজারে ৫০ টাকা, তাহলে হস্তশিল্পীও এখানে ২০ টাকা ঠকলেন। আবার নিজ নিজ উৎপাদিত পণ্যদির বিক্রয়ে এবং অপরের পণ্যদির ক্রয়ে কৃষক ক্রমান্¦য়ে ঠকতে থাকলে পরিণতিতে গোটা কৃষক সমাজের ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা নিশ্চিত করা গেলেও তাতে কৃষকের এক অংশের ধ্বংস এবং অপরাংশের সমৃদ্ধশালী হয়ে যাওয়াকে ব্যাখ্যা করা যাবেনা। কৃষক হলেই যখন বিক্রয়ে ক্রয়ে ঠকে তখন গরিব মাঝারী ধনী সব ধরণের কৃষকই নিশ্চিতভাবে ঠকে যায়। গরিব ও মাঝারী কৃষকের পতন সবার আগে হলেও এখানে কি ধনী কৃষক আদৌ বাঁচে। পরিশেষে দেখা যায়, বাজারই সকল ক্ষুদে ও মাঝারী উৎপাদকদের শোষণ করে দরিদ্র নিঃস্ব মজুরে পরিণত করেছে। বাজারই মূল শোষক, বাজার প্রতিযোগিতায় দেখা যায় ক্ষুদে উৎপাদকই পৃথকভাবে পারস্পারিক সাহায্য ছাড়াই যার যার মত বাজারের পণ্য উৎপাদন করছে। যদিও বাজারের কোন ধারণাই তাদের জানা ছিলনা পৃথকভাবে যখন ক্ষুদে উৎপাদকরা বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন করে বাজারের মাধ্যমে বুর্জোয়া ও ধণাঢ্য শ্রেণী এই ক্ষুদে উৎপাদকদের উৎপাদনকে ধ্বংস করে দিয়ে দরিদ্র নিঃস্ব ভূমিহীনে পরিণত করে। বাজার ভিত্তিক শোষণের কারণে অধিকাংশ শোষিত শ্রেণী সম্পদহীন নিঃস্ব দরিদ্র হয়ে যায়। পরে দেখা যায় সম্পদহীন নিঃস্ব উৎপাদকেরা ক্রমান¦য়ে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা হারিয়ে ফেলে মজুরি শ্রমিকে পরিণত হয়, তখন তাদের আশেপাশের বিত্তবান সম্পদশালী প্রতিযোগিদের কারবারে মুজুরি দাসত্ব শুরু হয়। কাল মার্কস বলেছেন- ‘বাজারে শ্রমিকেরা পণ্যের ক্রেতা হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ, তাদের নিজের পণ্য শ্রমশক্তির বিক্রেতা রূপে পুঁজিবাদী সমাজই সবসময় তাদের শ্রমশক্তির দাম সর্বনি¤œ পর্যায়ে দাবিয়ে রাখে’।
মূলত বাজারকেই কাল মার্কস মূল শোষক হিসেবে হাজির করেছেন। যে বাজার কারো ন্যায্য মূল্য পেতে দিচ্ছেনা বিনিময়টা সর্বদাই অসময়তায় করতে বাধ্য করছে। সেই বাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা কখনো বিনিময়টাকে দেখেননি। সীমিত পরিসরে বিনিময় প্রসঙ্গে সমাপ্তি টেনে এই কথা বলা যায় যে, পণ্য অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে কীভাবে পণ্য বিনিময় হয়, কি কি নিয়ম ঐ বিনিময়কে প্রভাবিত করে। পণ্যের দাম বাজারই নির্ধারণ করে রাখে শোষন করার জন্য। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ ভূমিদাস সামন্তবাদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহ সংগ্রাম করেছে, যার যার মত স্বাধীন হয়ে উপার্জন করার জন্য। কিন্তু এই শোষিত শ্রেণি কখনো জানতনা যে, এই তথাগুলো বিলোপ হয়ে গেলেও অন্যতম শোষক বাজার তাদের ঘাড়ে চেপে বসবে। ধনাঢ্য ও ধনতান্ত্রিক শ্রেণী সেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। শোষিত শ্রেণিকে তারা উৎপাদনের পণ্যে রূপান্তরিত করছে। শ্রমিককে এখানে মালিক পণ্য বা দাস হিসাবেই উৎপাদনের কাজ করায়। এই ভোগবাদী বুর্জোয়া বাজার ব্যবস্থাই এর জন্য দায়ী। শ্রমিকের শোষণ করা থেকে শুরু করে শোষিত শ্রেণীকে প্রত্যেক ধাপে ধাপে শোষণ করে যাচ্ছে এই বুর্জোয়া বাজার ব্যবস্থা। পুঁিজবাদী বাজার ব্যবস্থায় মানুষ যে মানুষ নয় সেটি একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যায়। আমরা টিভি বিজ্ঞাপনে দেখি কোন অভিনেত্রী যখন ফেয়ার লাভলী বা কোনো ক্রীমের বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করেন তখন আসলে তার শরীরটা আগে বিক্রি করা হয়। তাই একটি পণ্য বিক্রির জন্য একটি নারীকে পণ্য করে দিয়েছে পুঁজিবাদী বাজার। যদি ক্রীম মেখে মানুষ ফর্সা হয়ে যেত তবে আফ্রিকায় এখনও এত মানুষ কালো থাকার কথা নয়, শেষে দেখা যায় এই পুজিঁবাদী বাজার মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে নানা কৌশলে সে এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে কথা হল এই বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ। সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সুনামগঞ্জ জেলা সংসদ।