1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:০৩ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে

  • আপডেট সময় রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬

বিশেষ প্রতিনিধি::
বাংলাদেশে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলসহ দেশের কয়েকটি জেলায় গত এক দশকে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে এই হতাহতের মাত্রা। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বজ্রাঘাতে ৩৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ শিশু, ২ নারী ও ২২ পুরুষ রয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব মতে, গত ৫ বছরে সারা দেশে বজ্রপাতে সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, গত ৫ বছরে (২০১১-২০১৫) সারা দেশে ৫ হাজার ৭৭২টি বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে ২০১১ সালে ৯৭৮, ২০১২ সালে ১ হাজার ২১০, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৪১৫, ২০১৪ সালে ৯৫১ ও ২০১৫ সালে ১ হাজার ২১৮ বজ্রাঘাত হেনেছে বাংলাদেশে।
বজ্রপাতের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বাসাবাড়িতে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি তার মতা মাত্র ২২০ ভোল্ট। শিল্পকারখানায় ১২শ ভোল্টের বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। আর জাতীয় গ্রিডে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১১০ ভোল্ট বিদ্যুৎ যথেষ্ট।

বজ্রপাত নিয়ে কাজ করে দুর্যোগ ফোরাম। তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে (৪ এপ্রিল পর্যন্ত) বজ্রপাতে মারা গিয়েছেন ৩৬ জন। ২০১৫ সালে ৪০ শিশু, ২৩ নারী, ১২৩ পুরুষ মিলিয়ে ১৮৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৪ সালে ৩৯ শিশু, ২৮ নারী ও ১৪৩ পুরুষ মিলিয়ে ২১০, ২০১৩ সালে ৫৫ শিশু, ৫৩ নারী ও ১৭৭ পুরুষসহ ২৮৫ জন মারা যায়। ২০১২ সালে মারা যায় ৩০১ জন, এর মধ্যে রয়েছে ৬১ শিশু, ৫০ নারী ও পুরুষ। ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন, যার মধ্যে ৩১ শিশু, ২৮ নারী ও ১২০ পুরুষ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সংস্থাটি ওই প্রতিবেদন তৈরি করে। ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, লালমনিরহাট, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে।

বজ্রপাতের সৃষ্টির তথ্যানুযায়ী বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে পরের মৌসুমে এমনকি শীতের আগে পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গেই গরম বাতাসে জলীয় বাষ্প ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মেঘের ভেতরে যায়। এই জলীয় বাষ্প যত বেশি হবে মেঘের উষ্ণায়ন মতাও অস্বাভাবিক বেড়ে জ্যামিতিক হারে মেঘের সৃষ্টি হবে। বাতাসের এ প্রক্রিয়া ওপর ও নিচে দুভাবে চলতে থাকে। আপ ড্রাফ হলো মেঘের ওপরের স্তর এবং ড্রাউন ড্রাফ মধ্যম ও নিচের। এই মেঘই বজ্রমেঘ। এই দুই মেঘের মধ্যে বৈদ্যুতিক পজিটিভ ও নেগেটিভ বিকিরণে প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যালান্স (ভারসাম্য) আনার চেষ্টা হয়। পজিটিভ ও নেগেটিভ মেঘ একত্রিত হয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হলে বজ্রপাত হতে থাকে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এসএমআরসি) বিজ্ঞানী মো. আবদুল মান্নানের মতে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। সার্কভুক্ত অন্য দেশের তুলনায় মৃত্যুহারও বেশি। অন্যদিকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের’ ২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে। আর এসএমআরসির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০টি বজ্রপাত হয়। এতে বছরে মাত্র ১৫০ বা তার কিছু বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তবে সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের গবেষকদের পর্যবেণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে মারা যায় ৫০০ থেকে ৮০০ মানুষ।

দুর্যোগবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুরো বৈশিষ্ট্য নিয়েই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। অবশ্য বজ্রপাতকে এখনো সরকারিভাবে দুর্যোগের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ফলে বজ্রপাতে নিহতদের পরিবার সরকারিভাবে তেমন ক্ষতিপূরণ পায় না।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দেশে বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ নিয়ে সরকারি উদ্যোগে তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামান্য বৃষ্টিপাত বা ঝড়ো বাতাসেও ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। এ অস্বাভাবিকতার কারণ হিসেবে তারা ‘কালো মেঘ’ বেড়ে যাওয়াকে চিহ্নিত করেছেন। কালো মেঘ সৃষ্টির পেছনে বাতাসে নাইট্রোজেন ও সালফার গোত্রের গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই সালফার গোত্রের গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকার প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ৬৪-১৪৩ মাইক্রোগ্রাম সালফার ডাই-অক্সাইড বিদ্যমান। আর প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড রয়েছে ২৫-৩২ মাইক্রোগ্রাম, যা স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এটিই বজ্রপাতকে ত্বরান্বিত করে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোন অপারেটরের টাওয়ারকেও বজ্রপাতের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য দায়ী করছেন কেউ-কেউ। দেশের প্রবীণ নাগরিকরাও বলছেন, তাদের জীবদ্দশায় এত বজ্রপাতের ঘটনা তারা দেখেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ এবং ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ৫০ শতাংশেরও বেশি হতে পারে। কয়েকটি দেশের হিসাব কষে এই ফল দেওয়া হয়েছে। কঙ্গোয় ভূমি থেকে এক হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতায় কিফুকা পর্বতের এক গ্রামে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় বছরে প্রতি বর্গকিমিতে দেড়শ বার। পরবর্তী অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা উত্তর ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের ফোরিডা। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪৫ বার বজ্রপাত হয়। সেই হিসাবে বছরে এ সংখ্যা প্রায় দেড়শ কোটি বার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আকাশে মেঘ হলে তার ২৫ থেকে ৭৫ হাজার ফুটের মধ্যে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। এ এলাকায় তড়িৎ প্রবাহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ ঘটে। এখানে খাড়াভাবে যে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয় তার তাপমাত্রা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট। বজ্রপাতের গতিও প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার বেগে নিচে বা ওপরের দিকে চলে যায়। ফলে এ পরিমাণ তাপসহ বজ্রপাত মানুষের দেহে আঘাত হানার সঙ্গে-সঙ্গেই মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক।

সাধারণত আকাশের ৪ মাইল সীমার মধ্যে মেঘের সৃষ্টি হয়। এ সীমার ওপরে পানি, বাতাস থাকলেও তা ঠা-া এবং হাল্কা পরিমাণে থাকে। আকাশের এ সীমার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মেঘের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে কালো বা ঘন কালো মেঘ থেকে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে বিকালের দিকেই এ ধরনের মেঘ বেশি সৃষ্টি হতে দেখা যায়। অন্য সময়ে সংঘটিত মেঘে বজ্রের আওয়াজ থাকলেও বজ্রপাতের ঘটনা কম থাকে। সূর্যতাপ না থাকায় এবং ঠা-া আবহাওয়ার কারণে রাতের বেলায় বজ্রপাতের ঘটনা খুব কম হয়।

গ্রামাঞ্চলে বজ্র প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে বিশাল বৃক্ষ। এই বড় গাছ এখন খুবই কম। কালেভদ্রে বিশাল বট-পাকুড় আম জাম শিমুল কাঁঠাল চোখে পড়ে। বৃষ্টির সময় বিদ্যুতের ঝলকানি ও মেঘের গর্জনের মধ্যে গৃহবধূ উঠানে কাজ করে। কৃষক মাঠে থাকে। খোলা মাঠে ও উঠানে বিদ্যুৎ-আক্রান্ত হয় বেশি। বর্তমানে কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। আকাশে ঝলসানো বিদ্যুৎ এসব ধাতব বস্তুর সংস্পর্শে দ্রুত চলে আসে। বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার বেড়ে মৃত্যুর সংখ্যা দিনে-দিনে বাড়ছে তা রোধে কোনো ব্যবস্থা নেই। সচেতনতাও গড়ে তোলা হয়নি। ভূমিকম্পের সময় কী করণীয় তার প্রচার হয়। বজ্রপাত থেকে রা পাওয়ার কোনো ধারণাও দেওয়া হয় না। তবে আকাশে ঘনকালো মেঘ দেখার সঙ্গেই প্রস্তুতি নেওয়া, মেঘের ডাক শুনলেই নিরাপদে যাওয়া। পাকা বাড়ি সাধারণত নিরাপদ। ফসলের মাঠ, ফাঁকা মাঠ, উঠান, সৈকত, পাহাড়, গাছের নিচে বিদ্যুতের খুঁটির নিচে দাঁড়ানো বা নিচে দিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। বজ্রপাতের সময় ধাতব বস্তু স্পর্শ করা ঠিক নয়। এমনকি টিভি ফ্রিজ পানির মোটর বন্ধ থাকলেও তার স্পর্শ থেকে সাবধানে থাকা ভালো। এ সময় বৈদ্যুতিক ঝরনায় গোসল করা ঠিক নয়। পাকা বাড়ি হলেও তার ধাতব জানালায় হাত রাখা বিপদ হতে পারে। বিদ্যুতের সুইচ অফ রাখা বাঞ্ছনীয়। তারযুক্ত ফোন এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারও ঠিক নয়। কারণ মোবাইল ফোনের টাওয়ার বজ্রপাত টেনে নেয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com